সাঁওতাল

সাঁওতাল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের বাসস্থান মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায়। প্রধান নিবাস রাঢ়বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার অরণ্য অঞ্চল এবং ছোটনাগপুর; পরে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সাঁওতাল পরগনায়। তবে ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে পাবনা, যশোর, খুলনা, এমনকি চট্টগ্রাম জেলায়ও অল্প সংখ্যায় সাঁওতালদের বসতি ছিল। ১৯৪১ সালের জরিপ অনুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশ এলাকায় সাঁওতালদের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। দেশ বিভাগের পর লোকগণনার সময় সাঁওতালদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে গণ্য না করার ফলে বহুদিন তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা যায় নি। আশির দশকে খ্রিস্টান মিশনারিদের গৃহীত হিসাব অনুযায়ী উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল জনসংখ্যা লক্ষাধিক। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সাঁওতাল জনসংখ্যা দুই লক্ষের বেশি। ২০০১ সালের জরিপে এদের মোট সংখ্যা জানা যায় নি।

সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড) জনগোষ্ঠীর বংশধর। সাঁওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা, এরা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কৃষিসংস্কৃতির জনক ও ধারক হিসেবে স্বীকৃত।

সাঁওতাল নারী

সাঁওতালদের প্রধান উপাস্য যদিও সূর্য (তাদের ভাষায় সিং বোঙ্গা) তবু পর্বত দেবতাও (মারাং বুরু) তাদের জন্য যথেষ্ট মর্যাদাব্যঞ্জক হয়ে গ্রামদেবতায় পরিণত হয়েছে। সাঁওতালদের বিশ্বাস আত্মা অমর এবং সেই অনৈসর্গিক আত্মাই (বোঙ্গা) সব ঐহিক ভালমন্দ নির্ধারণ করে থাকে। তাই দৈনন্দিন পূজা-অর্চনায় বোঙ্গা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের গৃহদেবতা হিসেবে তাই ‘আবে বোঙ্গা’র যথেষ্ট প্রতাপ। এছাড়া লৌকিক হিন্দু দেবদেবীর প্রভাবও তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে দেখা যায়। সাঁওতাল নর-নারী আসলে ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতি উপাসক, আবার তারা ‘ঠাকুরজিউ’-কে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মান্য করে। তাদের ধর্মাচরণে মূর্তিপূজার প্রচলন নেই।

সাঁওতালরা খুবই উৎসবপ্রিয় জাতি। বাঙালিদের মতো এদেরও বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাদের বছর শুরু হয় ফাল্গুন মাসে। প্রায় প্রতিমাসে বা ঋতুতে রয়েছে পরব বা উৎসব যা নৃত্যগীতবাদ্য সহযোগে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নববর্ষের মাস ফাল্গুনে যেমন অনুষ্ঠিত হয় স্যালসেই উৎসব, তেমনি চৈত্রে বোঙ্গাবোঙ্গি, বৈশাখে হোম, আশ্বিনে দিবি, পৌষ শেষে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। সোহরাই উৎসব সাঁওতালদের একপ্রকার জাতীয় উৎসব যা পৌষ সংক্রান্তির দিন অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়। ফসলের দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশও এ অনুষ্ঠানের অঙ্গ। নাচ-গান-বাদ্য আর ফুলের মনোরম শোভায় এবং সেইসঙ্গে আহার্যে-পানীয়ে উৎসবটি হয়ে ওঠে জমজমাট। সম্ভবত এর বড় আকর্ষণ সাঁওতাল তরুণীদের দলবদ্ধ নৃত্য। সাঁওতালদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের নাম বাহা অর্থাৎ ফুলফোটার উৎসব। বসন্তের শুরুতে এ উৎসবের উদ্দেশ্য নানা রঙের ফুলফোটার সৌন্দর্যকে অভ্যর্থনা ও অভিনন্দন জানানো। এখানেও থাকে নাচ-গান ও বাদ্যের সমারোহ।

বসন্ত উৎসবের অন্যতম দিক হলো তরুণ-তরুণীদের জন্য চিত্তবিনিময়ের সুযোগ তৈরি করা। এ ধরনের চিত্তবিনিময় বা সঙ্গী-সঙ্গিনী নির্বাচনের কেন্দ্রস্থল হলো ‘আখড়া’। সাঁওতাল সমাজে তরুণ-তরুণীর বিবাহ-পূর্ব স্বাধীন মেলামেশায় কোনো বাধা নেই। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান রয়েছে। বিয়েতে কনেকে পণ দেওয়ার রীতি এখনও লোপ পায় নি, তবে তা অতিসামান্য। বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তদের পুনর্বিবাহের অধিকার স্বীকৃত।

সাঁওতাল নৃত্য

সাঁওতাল সমাজে পুরুষের আধিপত্য অপেক্ষাকৃত বেশি। তবু পারিবারিক জীবনে নারীর ভূমিকা কম নয়। জীবিকা অর্জনে বা কর্মজীবনে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সাঁওতালদের ঘর ছোট, কিন্তু গৃহাঙ্গন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। মাটির দেয়ালে নানারকম কারুকার্য চিত্রণ সাঁওতাল নারীর সৌন্দর্যস্পৃহা ও শিল্পমনের পরিচয় তুলে ধরে। ঘরের  আসবাবপত্র খুবই সাদামাটা যা তাদের সরল জীবনরীতির পরিচায়ক। সাঁওতাল সমাজ এখনও ঐতিহ্যবাহী পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় পরিচালিত এবং গ্রামপ্রধান সমাজে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে থাকে। সাঁওতালদের মধ্যে এখনও ১২টি গোত্রবিভাগ রয়েছে। সাধারণ নিয়মে একই গোত্রের ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তু এসব অনুশাসন এখন ততটা সচল নয়।

সাঁওতাল সমাজ প্রধানত কৃষিজীবী। কিন্তু আর্থ-সামাজিক কারণে দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। তাই বাধ্য হয়ে অতি অল্প বিনিময়মূল্যে এরা চা বাগানে বা অন্যত্র শ্রম বিক্রয় করে। এছাড়া এরা মাটি কাটে, মোট বয় বা অনুরূপ দিনমজুরির কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে। এরা কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত। সাঁওতাল নারী-পুরুষ ওরাওঁদের মতো দেহে উল্কিচিহ্ন ধারণ করে।

সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রিক ভাষার পরিবারভুক্ত। কোল ও মুন্ডারি ভাষার সঙ্গে সাঁওতালি ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। সাঁওতালদের সংস্কৃতিচর্চায় লিখিত সাহিত্যের বিকাশ না ঘটলেও লোকগীতি ও লোককাহিনীর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। সাঁওতালদের যেমন ভাষা আছে কিন্তু লেখ্য বর্ণমালা নেই, তেমনি তাদের ধর্ম আছে কিন্তু কোন আনুশাসনিক ধর্মগ্রন্থ নেই। খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা তাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হচ্ছে। প্রতিরোধ সংগ্রাম সত্ত্বেও জোতদার-মহাজনদের শাসন-শোষণ থেকে সাঁওতাল সমাজ মুক্ত হতে পারে নি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল অবধি বাংলাদেশে তেভাগা আন্দোলনে সাঁওতালদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কথা এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য।

সাঁওতাল সমাজে মৃতদেহ আগুনে ভস্মীভূত করার প্রথা প্রচলিত ছিল। গ্রামের কোন সদস্য মারা গেলে গ্রামপ্রধানকে সেখানে উপস্থিত হয়ে মৃতকে যথোচিত মর্যাদায় সৎকারের ব্যবস্থা করতে হয়। পরে সুবিধাজনক কোন এক সময় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের রীতিও তাদের সমাজে রয়েছে।  [আহমদ রফিক]