সররফ

সররফ ফারসী শব্দ, মানে ব্যাংকার।  সররফ ছিলেন মুগল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের প্রাথমিক যুগের  মুদ্রা বদলকারী, দালাল, ব্যাংকার, মুদ্রা পরখকারী, ঋণদাতা (পুঁজিদাতা), রাজস্ব জামিনদার ইত্যাদি বোঝায়। শব্দটি আরবি সররফ (ব্যাংকার) থেকে উদ্ভূত। সররফ পারিভাষিক শব্দটি বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি মুদ্রার ধাতব বিশুদ্ধতা যাচাই করেন এবং রাজকোষে জমা দেওয়ার আগে বাটার পরিমাণ কত হবে তা নির্ণয় করেন। ইউরোপ, ভারত ও চীনে সমসাময়িক বিশ্ববাণিজ্যে এ পারিভাষিক শব্দটির বহুল ব্যবহার ছিল। সররফকে পোদ্দার ও  বানিয়াও বলা হতো। এসব পদ বা পদবি মুগল মুদ্রা ব্যবস্থার অবদান। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে যে সকল বিদেশী সম্পর্কিত, তারা এ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বাণিজ্যে অন্যান্য অংশীদার দেশের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলার দায়পরিশোধ স্থিতি (balance of payment) বরাবরই অনুকূল ছিল। ফলে, এ দেশগুলিকে বাণিজ্য লেনদেনের ঘাটতি সোনা-রূপার পিন্ড (bullion) দিয়ে পূরণ করতে হতো। এভাবে আমদানি করা সোনা-রূপার পিন্ডগুলি কাজে লাগানোর বড় খাত হয়ে ওঠে অর্থনীতির বিশেষ ধাতবায়ন। ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনার টাকশালগুলিতে বিপুল পরিমাণে মুদ্রা তৈরি করা হতো। ১৭৫৭ সাল থেকে কলকাতার টাকশালেও মুদ্রা তৈরি শুরু হয়। মুগল আমলে এক প্রদেশের (সুবাহ) মুদ্রা অন্য সুবাহতেও বৈধ মুদ্রা (legal tender) হিসেবে গণ্য হতো। এভাবে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের জন্য ভারতে কেন্দ্রীয় মুগল সরকারের অন্যান্য টাকশাল থেকেও মুদ্রা আসতে থাকে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্কট মুদ্রা, বিশেষ করে ফরাসি ও ব্রিটিশ আর্কট মুদ্রা, দক্ষিণ ভারত থেকে আসতে থাকে।

তবে এসব মুদ্রার ধাতব মূল্য সমান ছিল না। উৎকর্ষের দিক থেকেও মুদ্রাগুলি এক রকম ছিল না। বাংলা সরকারের মুদ্রা সিক্কা রুপি নামে অভিহিত হতো। এ সিক্কা রুপি ছিল আদর্শমানের মুদ্রা। টাকশালে তৈরি হওয়ার তারিখ থেকে তিন বছর পর্যন্ত সিক্কা রুপির পূর্ণ মূল্য বজায় থাকত। এ তিন বছর পার হওয়ার পর একে সানাউত বা অপকর্ষিত মুদ্রা (debased coin) বলা হতো। সকল বিদেশী মুদ্রাকে সানাউত বলা হতো, কেননা সেগুলি সিক্কা রুপির ধাতব পরিমাণ ও উৎকর্ষের তুলনায় নিকৃষ্ট ছিল। আর এ কারণে অন্য সকল মুদ্রার মূল্য সিক্কা রুপির অনুপাতে স্থির করতে হতো। মুদ্রার  স্বকীয় বস্ত্তগত মূল্যমান অনুযায়ী এসব অপকর্ষিত মুদ্রার জন্য বাটা বা ছাড় দিতে হতো। সররফ তার পেশাদারি নৈপুণ্যের সুবাদে অবচয়ের মাত্রা ও নিরিখে সিক্কা রুপির সঙ্গে বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাটা কত দিতে হবে তা নির্ধারণ করতেন, সররফ সিক্কা রুপির বিনিময়ে সানাউত মুদ্রা কেনার কাজ করতেন। তিনি এ সানাউত মুদ্রাগুলি টাকশালে নিয়ে নতুন মুদ্রা তৈরি করাতেন। আর এসব কাজের জন্য তিনি টাকশাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি কমিশন পেতেন। বিনিময় করার জন্য যারা সনত মুদ্রা নিয়ে আসত তাদেরকে সররফদের প্রতারিত করার সুযোগ ছিল। তবে সররফ তাঁর সততার জন্য পরিচিত ছিলেন যদিও বিদেশী শাসকরা সাধারণত এই সররফকে প্রতারক বলেই মনে করত।

সিক্কা টাকার মানদন্ডেই কেবল সরকারি রাজস্ব আদায় করা হতো। ১৭৭০-এর দশক থেকে সিক্কা রুপি বিরল হয়ে ওঠে। ফলে জমিদারদের পক্ষে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধের বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে ওঠে। সররফরা জমিদারদের জন্য কেবল সিক্কা রুপিই সংগ্রহ করতেন না, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে ও দরবারে তাঁদের জামিনদার হিসেবে কাজ করতেন। জমিদারদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল না থাকলে তাঁরা সরকারের রাজস্ব পরিশোধের অন্যতম পন্থা হিসেবে সরকারি রাজস্ব সংগ্রহ দপ্তরে সররফ নিয়োজিত রাখতেন। সররফ তাঁদের পক্ষে রাজস্ব পরিশোধ করতেন। রাজস্ব বিক্রয় আইন তথা জমিদারদের কাছ থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ে কথিত  সূর্যাস্ত আইন বলবৎ করার চাপের মুখে জমিদারগণ সররফ নিয়োগ করেন। সররফ জমিদারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব সময়মতো পরিশোধ করে দিতেন। অর্থের লেনদেন এবং মুদ্রার বিনিময় চলে এমন প্রতিটি সরকারি রাজস্ব সংগ্রহ দপ্তরে, টাকশালে, অন্যান্য লোক ও বেসরকারি কার্যালয়ে কমিশনভিত্তিতে এ সররফগণ নিয়োজিত থাকতেন। সারাদেশ জুড়ে, এমনকি, বাংলার বাইরেও তাঁরা ব্যাপক যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তাঁরা তাঁদের সহযোগিতা ও গোটা দেশের বিভিন্ন স্বীকৃত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের  হুন্ডিও গ্রহণ করতেন। সররফগণ ছিলেন ধনী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। আর সে কারণেই সে আমলের লোকেরা তাঁদেরকে  মহাজন বলে সম্বোধন করত। শ্রেণি হিসেবে এ সররফদের আধিপত্য এক সময় হ্রাস পেতে থাকে ও উনিশ শতকের মাঝামাঝি মুদ্রা সংস্কার এবং আধyুনক ব্যাঙ্কিং ও প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চূড়ান্ত অবলুপ্তি ঘটে। তবে গ্রামীণ হাটবাজারগুলিতে এর পরে বহুকাল কোন না কোন আকারে ‘বাটা’ প্রথা প্রচলিত ছিল, যার আওতায় ১৮৩৫ সালে পুরাতন মুদ্রার প্রচলন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করার পরেও বহুকাল ঐসব মুদ্রার লেনদেন চলতে থাকে। সররফদের ব্যবসায় ত্রুটির অংশ ছিল ঋণ প্রদান। তবে উনিশ শতক ও তার পরবর্তীকালে সুদে কর্জদাতা যে মহাজন শ্রেণিটির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, তেমন সুদখোর মহাজন তাঁরা ছিলেন না।  [সিরাজুল ইসলাম]