সতীদাহ প্রথা
সতীদাহ প্রথা স্বামীর শব দাহের সঙ্গে বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত দাহ করার পূর্বেকার হিন্দুধর্মীয় প্রথা। সংস্কৃত ‘সতী‘ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে এমন সতীসাধ্বী রমণীকে বোঝায় যিনি তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত সততা প্রদর্শন করেন এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিও থাকেন সত্যনিষ্ঠ। কিন্তু একটি আচার হিসেবে সতীদাহের অর্থ হলো মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সহমরণের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা এবং ওই অনুষ্ঠানে তূরীবাদক জনতার মাঝে স্বামীর শেষকৃত্যের চিতায় আরোহণ করা। কবে এবং কিভাবে এ ধরনের আচার ধর্মীয় প্রথারূপে গড়ে উঠেছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। গ্রিক লেখক ডিওডোরাস (আনু. ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এক সতীদাহের ঘটনার বর্ণনা দেন। এই বর্ণনার সঙ্গে আঠারো শতকের প্রচলিত সতীদাহ ব্যবস্থার প্রায় অবিকল মিল রয়েছে। অতীতে বিশ্বের বহু সমাজে মানুষের আত্মাহুতি প্রথার অস্তিত্ব ছিল বলে নৃবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একমত। রাজপুতরা খুব ঘটা করে এই অনুষ্ঠানটি পালন করত। কিন্তু বাংলাসহ ভারতবর্ষের সকল প্রদেশে হিন্দুদের কোন কোন বর্ণের লোকেরা এই অনুষ্ঠান পালন করত ভিন্নতরভাবে। তুর্কি ও মুগল যুগে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফল হয় নি।
ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার প্রথম দিকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডে উদারপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং উনিশ শতকের বিশের দশকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভিত মজবুত হওয়ার পর সরকার কিছু জনহিতকর আইন প্রণয়নে চিন্তাভাবনা শুরু করে। খ্রিস্টান মিশনারি, ঈঙ্গ-ভারতীয় সংবাদপত্র এবং রাজা রামমোহন রায়সহ কতিপয় দেশীয় সংস্কারবাদী জনহিতকর সংস্কারের পক্ষে সমর্থন যোগান। অবশেষে নিজ দেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-১৮৩৩) রেগুলেশন XVII, ১৮২৯ পাস করেন। বেন্টিঙ্ক নিজেও একজন মানবহিতৈষী সংস্কারপন্থী ছিলেন। এই আইনে ‘সতীদাহ প্রথা বা হিন্দু বিধবা নারীকে জীবন্ত দাহ বা সমাধিস্থ করা বেআইনি’ বলে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু এরূপ বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে, এতে সতীদাহ প্রথার তাৎক্ষণিক উচ্ছেদ ঘটেছে। কোন অপরাধ বা সংস্কারকে ঘোষণা করলেই তা তৎক্ষণাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায় না। সতীদাহ ছিল একটি হিন্দু জাতীয় প্রথা। এটি ছিল আচারনিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল প্রাচীন প্রথা। তাই শুধু সরকারি আদেশ দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এর পরিপূর্ণ উচ্ছেদ সম্ভব ছিল না। গোড়া হিন্দু জনমত জনগণের ধর্মীয় অনুশীলনে উদ্ভট হস্তক্ষেপ বলে এই পদক্ষেপের নিন্দা করে। এর প্রতিকারের জন্য ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত শত শত হিন্দু কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠানো হয়। কিন্তু উদারপন্থী পার্লামেন্ট ভারতে বেন্টিঙ্ক সরকারের ব্যবস্থার পক্ষে খুব শক্ত অবস্থান নেয়। ঊনিশ শতকে এই প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে সাধারণ জনমত গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পূর্বের চেয়ে সীমিত পরিসরে হলেও এর অনুশীলন অব্যাহত ছিল। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে অমানবিক প্রথা হিসেবে সতীদাহ প্রথার পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, খৃষ্টান মিশনারীদের প্রচার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও হিন্দু সংস্কারবাদী আন্দোলনের ফলেই সতীদাহ প্রথা সমূলে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়েছিল। [সিরাজুল ইসলাম]