শৈলকূপা মসজিদ

শৈলকূপা মসজিদ  বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। এটি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানা সদরে অবস্থিত এবং মধ্যযুগীয় মুসলিম বাংলার একটি অনুপম স্থাপত্যকীর্তি। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের পুত্র নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহের আমলে আনুমানিক ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত। স্থাপত্যটিতে কোন শিলালিপি বর্তমানে নাই। লাল রঙের ছোট ছোট ইটের তৈরী এ মসজিদে প্লাস্টারবিহীন ইটের গাঁথুনি দেখা যেতো, যা আধুনিককালে প্লাস্টারে ঢাকা পড়ে গেছে।

মসজিদটির প্রতিটি দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৫ ফুট। আয়তাকারে নির্মিত মসজিদটির চারকোণায় চারটি গোলাকার টাওয়ার রয়েছে। নিচ থেকে উপর দিকে ক্রমশ ঢালুভাবে নির্মিত নীরেট টাওয়ারগুলি চারকোণায় দেওয়ালের মধ্যে অর্ধ নিমগ্ন অবস্থায় বিদ্যমান। পরবর্তীকালে কার্নিসের উপর বর্ধিত করে সেগুলিকে মিনারের রূপ দেওয়া হয়েছে। গোড়া থেকে চূড়া পর্যন্ত মোট নয়টি মোল্ডিং ব্যান্ড দিয়ে মিনারগুলি অলংকৃত এবং এদের শীর্ষে শোভা পাচ্ছে কিউপোলার উপর কলস ফিনিয়াল। মসজিদটির বহির্দিকের পরিমাপ ৪৪ ফুট × ৩৩ ফুট এবং ভেতরে নামায কক্ষের পরিমাপ ৩৩ ফুট × ২২ ফুট। পূর্ব দিকের সম্মুখভাগের ঠিক মাঝখানে প্রধান খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার এবং এর দুপাশে আরও দুটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে।

শৈলকূপা মসজিদ, ঝিনাইদহ

উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালেও দুটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশপথ আছে। দ্বিকেন্দ্রিক সুঁচালু খিলানের সাহায্যে এই প্রবেশপথগুলি নির্মিত। ভূমি থেকে মসজিদের কার্নিসের উচ্চতা ১৮ ফুট। কার্নিসের নিচ দিয়ে অনুভূমিক কয়েকটি মোল্ডিং ব্যান্ড দিয়ে বহির্দেওয়াল অলঙ্কৃত। মসজিদের ছাদটি কিছুটা বাঁকা করে নির্মিত। কার্নিসটি বক্র ছাদের মধ্যস্থল থেকে ক্রমশ দুদিকে ঢালু হয়ে কোণার টাওয়ারগুলিতে মিশেছে। কার্নিসের নিচ দিয়ে ইমারতের চতুর্দিকের বহির্গাত্র এবং পার্শ্ব দেয়ালের খিলানগুলির উপরের অংশ অলঙ্কৃত পোড়ামাটির ফলক দ্বারা আবৃত ছিল।

নামায কক্ষের কিবলা দেয়ালে রয়েছে তিনটি অবতল মিহরাব। সাড়ে পাঁচ ফুট পুরু দেয়ালের মধ্যে দ্বিকেন্দ্রিক সুঁচালু খিলানের সাহায্যে কুলুঙ্গি তৈরি করে মিহরাবগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মাঝখানের মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় সেটা দেয়ালের কিছুটা বাইরে প্রসারিত। পশ্চিম দেয়ালে আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে তৈরি মিহরাবগুলির অবতল দিকে ফুল ও জ্যামিতিক নকশা দ্বারা অলঙ্কৃত এবং ফ্রেমের উপরে কলসাকার ফুলের টব ও পদ্ম ফুলের অলঙ্করণ রয়েছে।

নামায কক্ষ দুটি আইল এবং তিনটি বে-তে বিভক্ত। কালো পাথরের তৈরী দুটি অষ্টকোণাকার স্তম্ভের উপর খিলানের সাহায্যে গম্বুজ বসিয়ে নামায কক্ষটি আচ্ছাদিত। দেড় ফুট পরিধি এবং ছয় ফুট উঁচু পিলার দুটির কোন দৃশ্যমান ভিত (Basement) নেই। পিলার দুটির মাথায় ক্রুশাকার ক্যাপিটাল বসিয়ে তার উপর থেকে গম্বুজের জন্য দ্বিকেন্দ্রিক সুঁচালু খিলান উৎসরণ করা হয়েছে। একটি স্তম্ভ থেকে উৎসারিত চারটি খিলানের মধ্যে তিনটি তিন দিকের দেয়ালে নিমগ্ন প্লাস্টারের সাথে এবং চতুর্থটি পার্শ্বস্থ অন্য স্তম্ভের সাথে মিশেছে। এভাবে পিলার ও খিলানের সাহায্যে নির্মিত ছয়টি চৌকোণ খোঁপের প্রতিটি কোণায় পেন্ডেন্টিভের সাহায্যে গোলাকার ভিত তৈরি করে তার উপর ছয়টি গম্বুজ বসানো হয়েছে। কর্বেল পদ্ধতিতে নির্মিত পেন্ডেন্টিভগুলিতে বাংলার নিজস্ব পদ্ধতিতে ইটের নকশা দেওয়া। মেঝে থেকে গম্বুজের সিলিং-এর উচ্চতা ২১ ফুট। ভেতর দিক থেকে গম্বুজগুলি বেশ উঁচু মনে হলেও এতে কৌশলগত ড্রাম ব্যবহার না করায় বাইরে থেকে সেগুলি তেমন দৃষ্টি গোচর হয় না। এছাড়া গম্বুজগুলি সুশোভিত করার জন্য এদের শীর্ষে কোন ফিনিয়াল ব্যবহার করা হয়নি। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণ একটু ডেবে গেছে। নামায কক্ষের সামনে রিওয়াক বেষ্টিত সাহান কিংবা আযানের জন্য পৃথক কোন মিনারের ব্যবস্থা নেই।

মুসল্লীদের ওজুর প্রয়োজনে মসজিদটির উত্তর দিকে শান বাঁধানো একটি পুকুর লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটির পূর্ব প্রাঙ্গণে ৪০ গজ দূরে একটি দেয়াল ঘেরা চত্বরের মাঝে দরবেশ মওলানা মুহম্মদ আরব এবং উজির শাহ আলীর সমাধি ফলক বিদ্যমান। অযত্ন অবহেলায় এই অনুপম স্থাপত্যকীর্তিটি বিলুপ্ত হতে চলেছিল। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে স্থানীয় কতিপয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মসজিদটি সংস্কার করেন।  [মোহাম্মদ আলমগীর]