শিব

শিব  হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা। ঈশ্বরের সৃজন, পালন ও সংহার এই ত্রিশক্তি যথাক্রমে  ব্রহ্মাবিষ্ণু ও শিব এই তিন দেবতারূপে পরিচিত। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন আর শিব ধ্বংস করেন। এই সৃজন-পালন-সংহার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জগৎসংসার চলমান আছে।

শিব অনার্য দেবতা, অর্থাৎ আর্যদের ভারত আগমনের পূর্বে ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীর দেবতা ছিলেন শিব। তিনি খুব প্রভাবশালী ছিলেন, তাই আর্যসমাজে তাঁর স্থান হয়েছে। বেদে তিনি রুদ্র নামে উল্লিখিত হয়েছেন। এই রুদ্রই পরবর্তীকালে শিব বা মহাদেব নামে বহুল পরিচিতি লাভ করে।

পাথরের শিবমূর্তি, কাশিপুর, বরিশাল

শিবের সঙ্গে সমাজের একেবারে সাধারণ মানুষের নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায়। তাঁর পার্ষদরা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি। তাঁর নিজের চলাফেরা, কাজকর্ম এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদেও কৌলীন্যের ছাপ নেই। তাঁর পরিধানে ব্যাঘ্রচর্ম ও মৃগচর্মের উত্তরীয়, মাথায় জটা, গলদেশে সর্পের উপবীত এবং হাতে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে জানা যায় যে, দারিদ্রে্যর কারণে তাঁকে ভিক্ষাও করতে হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি প্রাচীন ভারতের একটি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি অল্পতেই রুষ্ট, আবার অল্পতেই তুষ্ট হন। এজন্য তাঁকে ভোলানাথও বলা হয়। তাঁর মধ্যে একটি শিশুসুলভ কোমল মন লক্ষ করা যায়। কারও দুঃখকষ্ট এবং আবেদনে তিনি অতি সহজেই সাড়া দেন। তাই তাঁর বরে বৃত্র, বাণ প্রভৃতি অসুর অত্যাচারী হয়ে উঠলে শেষে ইন্দ্র, বিষ্ণু প্রভৃতির হাতে তারা নিহত হয়। কোনো কিছুর প্রতি তাঁর কোনো মোহ নেই। পুরাণাদির বর্ণনায় দেখা যায় শিব একা নন; তাঁর দাম্পত্য জীবনের সঙ্গিনী হচ্ছেন সতী (পরে পার্বতী, উমা বা দুর্গা); কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী তাঁদের পুত্রকন্যা। শিবের এই সংসার-জীবনের সঙ্গে বাঙালির সংসার-জীবনের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাঙালির জামাই-মেয়ে যেমন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যায়, তেমনি শিব-পার্বতীকেও দেখা যায় শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যেতে। এমনটি অন্য কোনো দেবতার ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

শিব জগতের কল্যাণের জন্য অনেক দুঃসাহসিক কাজ করেছেন। যেমন সমুদ্রমন্থনে উত্থিত তীব্র বিষ কণ্ঠে ধারণ করে তিনি পৃথিবীকে রক্ষা করেছেন। এতে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গেলে তাঁর নাম হয় নীলকণ্ঠ। ত্রিপুর নামক অসুরকে বধ করায় তাঁর নাম হয় ত্রিপুরারি। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিবের আরও অনেক নাম হয়। যেমন সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ বলে তিনি মহাদেব। তাঁর প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল, তাই তাঁর এক নাম শূলপাণি। পিনাক নামক ধনু ধারণ করেন বলে তাঁর অপর নাম হয় পিনাকী। সকল ভূত (জীব)-এর ঈশ্বর বলে তিনি ভূতনাথ বা ভূতেশ নামেও পরিচিত।

শিবের ধ্বংসকারী অস্ত্রের নাম পাশুপত। প্রলয়কালে তিনি বিষাণ ও ডমরু বাজিয়ে সব কিছু ধ্বংস করেন, তাই তাঁর অপর নাম মহাকাল। তবে ধ্বংস থেকেই আবার নতুন সৃষ্টির শুরু বলে শিবকে মঙ্গলের দেবতাও বলা হয়। তিনি একাধারে মহাযোগী, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী ও কঠোর তপস্যাকারী। তাঁর তপস্যাস্থল হিমালয়। কৈলাস তাঁর আবাস ভূমি। ধ্বংসের সময় তিনি যে তান্ডব নৃত্য করতেন তা আধুনিক নৃত্যকলার একটি অঙ্গ। এজন্য তিনি নটরাজ নামেও খ্যাত। নৃত্যশিল্পীদের নিকট তাঁর নটরাজ মূর্তি উপাস্য দেবতার মতো। তাঁর অপর নাম আশুতোষ, যেহেতু তিনি অল্পতেই তুষ্ট হন। ভক্তিভরে শুধু একটি বিল্বপত্র দিলেই তিনি খুশি। তবে তাঁর আত্মসম্মানবোধও কম নয়। শ্বশুর দক্ষের যজ্ঞস্থলে স্বামিনিন্দায় ক্ষুব্ধ সতী দেহ ত্যাগ করলে শিব দক্ষযজ্ঞ লন্ডভন্ড করে দেন। তিনি যখন শোকোন্মত্ত অবস্থায় সতীর মৃতদেহ স্কন্ধে নিয়ে নৃত্য করছিলেন, তখন বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ খন্ড-বিখন্ড করে ফেলেন। সেই খন্ডগুলি ভারতের যে যে স্থানে পতিত হয়, সে সে স্থান ৫১টি পীঠ ও ২৬টি উপপীঠ বা তীর্থস্থানে পরিণত হয়।

শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে শিব স্বয়ং ঈশ্বররূপে বন্দিত হয়েছেন। এছাড়া সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় তাঁর কাহিনী নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। বাংলা মঙ্গলকাব্যের দেবখন্ডে শিবের কাহিনী একটি আবশ্যিক বিষয়রূপে গৃহীত হয়েছে। শিবের  গাজন এক সময় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল। বর্তমানেও কোনো কোনো অঞ্চলে এ উৎসব পালিত হয়। হিন্দুদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস-ভক্তিতে আজও শিবের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়বদ্ধ। ভারতের ন্যায় বাংলাদেশেও শিবচতুদর্শী তিথিতে ভক্তগণ শিবরাত্রিব্রত উদ্যাপনসহ শিবলিঙ্গে অর্ঘ্য নিবেদন করে এবং কোথাও কোথাও এ উপলক্ষে মেলাও বসে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শিবের মন্দির রয়েছে।  [পরেশচন্দ্র মন্ডল]