শাহবাগ

শাহবাগ  ঢাকার নওয়াবদের বাগানবাড়ি। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র, কলাভবন ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সংলগ্ন এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল এই বাগানবাড়ি। মুগল আমলে বর্তমান হাইকোর্ট ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমী এলাকায় ছিল বাগ-ই-বাদশাহী এবং বর্তমান বাংলা একাডেমী ও টি.এস.সি এলাকায় ছিল সুজাতপুর আবাসিক অঞ্চল। সুজাতপুরের উত্তরে পরবর্তী সময়ে নূরুদ্দীন হোসেন কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল নূর খান বাজার। বাগ-ই-বাদশাহী ও সুজাতপুরের মাঝে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠটি রমনা নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের প্রথম দিকে সুজাতপুর এলাকায় আর্মেনীয় ভূস্বামী আরাতুন এবং ব্রিটিশ বিচারক গ্রিফিথ কুক দুটি বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন। এই শতকের চল্লিশের দশকে নওয়াব খাজা আব্দুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ ওই বাগানবাড়ি দুটি কিনে নেন।

ইশরাত মঞ্জিল,শাহবাগ

১৮৬৮ সালে নওয়াব আবদুল গণি জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পুত্র খাজা আহসানুল্লাহকে প্রদান করেন। আবদুল গণি অবসর কাটাতে মনের মতো একটি বাগানবাড়ি তৈরি করতে মনস্থ করেন। ১৮৭০-৭১ সালে তিনি বর্তমান কলাভবন এলাকাটি নূরুদ্দীন হোসেনের ছেলের নিকট থেকে ক্রয় করেন। ১৮৭৬-৭৭ সালে এর উত্তরাংশ কেনা হয়। শাহবাগে মোট জমির পরিমাণ ছিল প্রায় দুশ বিঘা। ১৮৭৩ সালে শাহবাগ বাগানবাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। মুগলদের বিলাসবহুল বাগ-ই-বাদশাহীর অনুকরণে নওয়াব আবদুল গণি এর নামকরণ করেছিলেন ‘শাহবাগ’। এর উত্তর পাশেই নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর আমলে গড়ে ওঠে ‘পরীবাগ’ বাগানবাড়ি।

বাগানবাড়িটির চারদিক দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়েছিল। এর মাঝে বেশ কয়েকটি প্রাসাদোপম অট্টালিকা, মার্বেল পাথরে বাঁধানো বৈঠকখানা এবং অনেকগুলি বাঁধানো চত্বর ছিল। এখানে অাঁকাবাঁকা সরু লেকগুলির দৈর্ঘ্য ছিল কয়েক কিলোমিটার। আরও ছিল অনেকগুলি বৃহদাকার প্রাকৃতিক ও বাঁধানো সরোবর। কোন কোন সরোবরের মধ্যখানে ছিল দ্বীপাকারে নির্মিত গোল চত্বর ও চন্দ্রাতপ এবং সেগুলিতে যাতায়াতের জন্য ছিল সেতু। এখানে নানা রঙের বাহারি মাছসহ অনেকগুলি চৌবাচ্চা এবং নানা ধরনের ফোয়ারা ছিল। রঙ-বেরঙের গাছ-গাছালি এবং দেশী বিদেশী ফুল-ফলের গাছে পুরো বাগানটি ছিল সাজানো। বাগানটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তৎকালের দুই বিখ্যাত কবি উবায়দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল গফুর নাসসাখ কবিতা রচনা করেছিলেন।

শাহবাগে ‘ইশরাত মঞ্জিল’ নামে দ্বিতল ভবনটি ছিল সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়। ১৯০৬ সালে শাহবাগে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতির অধিবেশনে আগত অতিথিদের এখানে স্বাগত জানানো হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকায় ‘মধুর কেন্টিন‘ নামে পরিচিত ভবনটি ছিল এ বাগানবাড়ির জলসাঘর। ভবনটির মেঝে ও চতুর্দিকের প্রশস্ত অঙ্গন ছিল মার্বেল পাথরে বাঁধানো। এখানে নওয়াব পরিবারের লোকেরা স্কেটিং অনুশীলন করতেন বলে ভবনটিকে ‘স্কেটিং প্যাভিলিয়ন’ও বলা হতো। এই ভবনটির দুটি গোলাকার কক্ষ আজও টিকে আছে। ১৯০৬ সালে উপরিউক্ত অধিবেশনটি এই ভবন প্রাঙ্গণেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শাহবাগে ‘নিশাত মঞ্জিল’ নামে আরেকটি দ্বিতল ভবনে দুর্লভ বস্ত্তর একটি পারিবারিক জাদুঘর ছিল। বর্তমান কাঁটাবন মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে বৃত্তাকারে নির্মিত আস্তাবলটিও (বর্তমানে বিলুপ্ত) শাহবাগ বাগানবাড়ির অংশ ছিল। নওয়াবদের ঘোড়া ছাড়াও ঘোড়দৌড়ের সময় ঢাকায় আগত প্রতিযোগীদের ঘোড়াও সেখানে রাখা হতো। শাহবাগের পূর্ব পাশে অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানটিও ঢাকার নওয়াবদের মালিকানায় ছিল। ঘোড়দৌড়ের সময় আগত ইংরেজ সাহেব-মেমদের জন্য শাহবাগ বাগানবাড়িতে ভোজসভা ও বল নাচের আয়োজন করা হতো। শাহবাগে নওয়াব সাহেব একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন।

শাহবাগ জলসাঘর (স্কটিং প্যাভেলিয়ন)

১৮৭৫ সাল থেকে প্রতি বছর খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে শাহবাগে কৃষিজ ও দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যের মেলা অনুষ্ঠিত হতো। উক্ত মেলায় প্রদর্শিত শ্রেষ্ঠজাতের পশু-পাখি ও কৃষিজাত দ্রব্যের জন্য নওয়াবের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়া হতো। মেলা উপলক্ষে শাহবাগ সুন্দরভাবে সাজানো হতো। নওয়াবের ব্যয়ে সেখানে নর্তক-নর্তকী, গায়ক-গায়িকারা নাচগান করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করত। যাত্রা, পুতুল নাচ, ম্যাজিক, বায়াস্কোপেরও ব্যবস্থা থাকত। মেলার সময় ব্যতীত বাগানটিতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে অনুমতি নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখার জন্য প্রবেশ করা যেত। ১৯২১ সাল থেকে নওয়াবজাদি পরীবানু ঢাকার সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বেড়ানোর জন্য প্রতি শনিবার বিকালে বাগানটি খুলে রাখার ব্যবস্থা করেন। ১৯০১ সালে নওয়াব আহসানুল্লার ব্যয়ে  ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও শাহবাগে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয় নি। তবে সেখানে বিদ্যুতায়নের জন্য আগে থেকেই পৃথক জেনারেটর ছিল। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথমভাগ জুড়ে শাহবাগ ছিল ঢাকার উচ্চ পর্যায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রভূমি। ঢাকার নওয়াবদের পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ঢাকায় আগমন কিংবা বিদায় উপলক্ষে এখানে ঘটা করে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করা হতো। ১৮৮৮ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গের ছোটলাট  বেইলীকে এবং ২৬ নভেম্বর বড়লাট লর্ড  ডাফরিনকে শাহবাগে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৮৯১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ও ১৮৯৪ সালের ২০ জুলাই বঙ্গের ছোটলাট চার্লস  ইলিয়টকে এবং ১৯০২ সালের ২১ জুলাই ছোটলাট উডবার্নকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য শাহবাগে অনুষ্ঠান করা হয়।

১৮৯৬ সালের ২৫ জানুয়ারি ইনসপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন মৌলভী দেলোয়ার হোসেনের ঢাকা পরিদর্শন উপলক্ষে শাহবাগে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯০৪ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি লর্ড কার্জন বাগানবাড়িটি পরিদর্শন করেন। নওয়াব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালের ১৪ ও ১৫ এপ্রিল শাহবাগে এই অঞ্চলের পাঁচ হাজার মুসলমানের এক সভায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলমান শিক্ষা সমিতি গঠিত হয়। ওই বছরই নওয়াব সাহেবের উদ্যোগে শাহবাগে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতির অধিবেশনে ৩০ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ১৯০৮ সালের ২৩ জুলাই পূর্ববঙ্গের ছোটলাট বেইলীকে এখানে স্বাগত সংবর্ধনা এবং ১৯১২ সালের ২১ মার্চ তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মুসলিম প্রতিনিধিদল শাহবাগেই বড়লাট লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বড়লাট তাঁদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। ১৯১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি লর্ড কারমাইকেল এবং ১৯২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লর্ড রোনাল্ডসে-কে এখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

১৯১৫ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর ঢাকার নওয়াবদের জমিদারি দ্রুত পতনের ন্যায় অর্থাভাবে শাহবাগেরও জৌলুস কমতে থাকে। তাছাড়া পারিবারিক কোন্দলের দরুন ক্রমে সেটা অংশীদারদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। তবুও বিশ শতকের চল্লিশের দশকের প্রারম্ভ পর্যন্ত শাহবাগে মাঝে মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হতো।  [মোহাম্মদ আলমগীর]

গ্রন্থপঞ্জি AH Dani, Dacca, A Record of its Changing fortunes, 1956; SM Tafoor, Glimpses of Old Dhaka, 1956; Azimusshan Haider, Dacca, History and Romance in Place names, 1967.