লোহানী, ফতেহ

ফতেহ লোহানী

লোহানী, ফতেহ (১৯২০-১৯৭৫)  অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক ও সাংবাদিক। আবু নজীর মোহাম্মদ ফতেহ আলী খান লোহানী সিরাজগঞ্জে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে বহুগণের অধিকারী ছিলেন যেমন, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অগ্রণী অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক, সংবাদ পাঠক, আবৃত্তিকার ও অনুবাদক। পিতা সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবু সাঈদ মোহাম্মদ সিদ্দিক হোসেন খাঁ (আবু লোহানী), মাতা স্কুল শিক্ষিকা ও লেখিকা ফাতেমা লোহানী। মায়ের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় তাঁর শিক্ষাজীবনের সূত্রপাত ঘটে। সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল মিশন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, রিপন কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাস করার পর ১৯৫০-এ তিনি লন্ডন গমন করেন এবং ওল্ডভিক থিয়েটার স্কুলে নাট্য প্রযোজনা বিষয়ে দুবছরের কোর্স সমাপ্ত করেন। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সদস্য হিসেবে তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।

কলকাতার স্কুলে পড়ার সময় তিনি অভিনয়, কৌতুকাভিনয় ও আবৃত্তি করতেন। রিপন কলেজে পড়ার সময় তিনি বহু বাংলা ও ইংরেজি নাটকে অভিনয় করেন। কলেজে অভিনীত তাঁর প্রথম নাটক বনফুল রচিত শ্রী মধুসূদন-এ তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক উৎপল দত্ত পরিচালিত হ্যামলেট। পরে তিনি শৌখিন নাট্যগোষ্ঠী ও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি পরিচালনা ও তাতে অভিনয় করেন। বাণী থিয়েটার-এর মঞ্চে তিনি রামের সুমতি নাটকে অভিনয় করেন। পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী ‘আলোক তীর্থ’-এর উদ্যোগে রঙমহল-এ মঞ্চস্থ হেমেন রায়ের নর-নারী নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রখ্যাত ক্যামেরাম্যান চলচ্চিত্রকার বিমল রায় তাঁকে হিন্দি চিত্র হামরাহী (১৯৪৫)-র একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন, সেই সঙ্গে তাঁর নতুন নাম হয় কিরণ কুমার।

এর পাশাপাশি তিনি অভিনয় করেন রঙিলা আর্ট কর্পোরেশন প্রযোজিত উদয়ন চৌধুরী (ইসমাইল মোহাম্মদ) রচিত ও পরিচালিত জোয়ার নাটকে এবং হিমাদ্রি চৌধুরী (ওবায়েদ-উল হক) রচিত, প্রযোজিত ও পরিচালিত দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) চলচ্চিত্রে। এছাড়াও কলকাতায় বিভাগ-পূর্বকালে তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় জড়িত হন। তখন তিনি কাজ করতেন দৈনিক আজাদ ও সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ-এ। বেতারের অনুষ্ঠানেও তিনি অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর ফতেহ লোহানী ঢাকা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন সংবাদ পাঠক হিসেবে, সেইসঙ্গে নাটক ও আবৃত্তিতেও অংশ নিতেন।

ফতেহ লোহানী কিছু গানও রচনা করেন। ঢাকা থেকে ১৯৪৯-এ মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অগত্যা প্রকাশে তিনি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। ঐ বছরই তিনি যোগ দেন করাচি বেতারে, পরে বিবিসি-তে। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত হন, পাশাপাশি বেতার অনুষ্ঠান, অভিনয় এবং লেখালেখিতেও মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) প্রতিষ্ঠার পর তাঁর পরিচালিত প্রথম দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিল আকাশ আর মাটি (১৯৫৯) ও আসিয়া (১৯৬০)। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত উর্দু ছবি সাত রং। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথম অভিনয় করেন টেলিভিশন নাটক নির্ভীক-এ। ঢাকায় তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র রাজা এলো শহরে (১৯৬৪)। ফতেহ লোহানী অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে মুক্তির বন্ধন (১৯৪৭), তানহা (১৯৬৪) বেহুলা (১৯৬৬), ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো (১৯৬৬), আগুন নিয়ে খেলা (১৯৬৭), দরশন (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), এতটুকু আশা (১৯৬৮) বাল্যবন্ধু (১৯৬৮), মোমের আলো (১৯৬৮), মায়ার সংসার (১৯৬৯), মিশর কুমারী (১৯৭০), তানসেন (১৯৭০), অাঁকাবাঁকা (১৯৭০), অন্তরঙ্গ (১৯৭০), ঘূর্ণিঝড়, (১৯৭০), স্বরলিপি (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), অপবাদ (১৯৭০), ডাকু মনসুর (১৯৭৪), দুই রাজকুমার (১৯৭৫), এক মুঠো ভাত (১৯৭৫), কুয়াশা (১৯৭৭) প্রভৃতি উলে­খযোগ্য। ফতেহ লোহানী রচিত কয়েকটি নাটক হচ্ছে নিভৃত সংলাপ, দূর থেকে কাছে ও সাগরদোলা। তাঁর অনূদিত নাটকসমূহ হচ্ছে, একটি সামান্য মৃত্যু (আর্থার মিলারের ডেথ অব এ সেলসম্যান), চিরন্তন হাসি (ইউজিন ও নীলের ল্যাজারাস লাফড), বিলাপে বিলীন (ইউজিন ও নীলের মর্নিং বিকামস ইলেক্ট্রা) এবং উপন্যাস সমুদ্রসম্ভোগ (আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি)।

কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬১-তে শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র আসিয়া-র জন্য), পাকিস্তানের নিগার পুরস্কার (১৯৬-তে শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা আসিয়া), পাকিস্তানের মজিদ আলমাক্কী পুরস্কার (১৯৬৮-তে শ্রেষ্ঠ বেতার নাট্য-অভিনেতা), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার ১৯৭৫ (অভিনয়- চলচ্চিত্র) এবং এফডিসি-র রজত জয়ন্তী ট্রফি (১৯৮৩) উল্লেখযোগ্য।

চট্টগ্রামের কাপ্তাই-এ কুয়াশা ছবির শুটিংয়ে নিয়োজিত থাকাকালে ১৯৭৫ সালের ১২ এপ্রিল ফতেহ লোহানীর মৃত্যু হয়। [অনুপম হায়াৎ]