লায়ন ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ

লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ  এর কার্যক্রমের সূচনা ঘটে চট্টগ্রামে ১৯৫৮ সালে এম আর সিদ্দিকীর উদ্যোগে প্রথম লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং সংঘটিত করার মাধ্যমে। একই সময়ে ঢাকায় লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল-এর আরেকটি ক্লাব গঠন করা হয়- এটির নাম ছিল লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল ১৯৫৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে এই ক্লাবটিকে এবং একই বছরের ২ এপ্রিল তারিখ চট্টগ্রাম লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালকে বিধিবব্ধ ক্লাবের মর্যাদা প্রদান করে। উল্লেখ্য, ঐ সময়ে এ দুটি লায়ন্স ক্লাব লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩০৫ (পাকিস্তান)-এর আওতাধীন ছিল।

১৯৬২-৬৩ সালে ৩০৫ নম্বর ডিস্ট্রিক্টকে একটি মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট-এ রূপান্তরিত করে দুটি সাব ডিস্ট্রিক্ট যথা ৩০৫ ডব্লিউ (পশ্চিম পাকিস্তান) এবং ৩০৫-ই (পূর্ব পাকিস্তান) গঠন করা হয়। লায়ন এম আর সিদ্দিকী ছিলেন ৩০৫-ই সাব ডিস্ট্রিক্ট-এর প্রথম সাময়িক ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর। তিনি ১৯৬২-৬৩ এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে পরপর দুই মেয়াদে এই পদ অলংকৃত করেন। ১৯৬৩-৬৪ সনে তিনি মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট-এর চেয়ারম্যান ছিলেন।

স্বাধীনতাত্তোরকালে লায়ন এম আর সিদ্দিকী পুনরায় বাংলাদেশে লায়ন আন্দোলন সংগঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবডিস্ট্রিক্টকে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিস্ট্রিক্ট-এ উন্নীত করে এর সাময়িক ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর হিসাবে তাঁকে ১৯৭২-৭৩ এবং ১৯৭৩-৭৪ মেয়াদের জন্য নিয়োগ করা হয়। লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ ঐ সময়ে বাংলাদেশের ৩৭টি লায়ন্স ক্লাব নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ক্লাবগুলির সদস্য ছিলেন ১,২৫০ জন লায়ন। ১৯৭৪-৭৫ সালে নতুন ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নির্বাচিত হন এম এ খালেদ। লায়ন্স ক্লাবগুলোর সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশে এগুলির কার্যক্রম ও বিস্তৃত হতে থাকে। লায়ন্স আন্দোলনের দ্রুত বিস্তৃতির ফলে ১৯৮৭-৮৮ সালে লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট ৩১ কে বিভক্ত করে ৩১৫এ ও ৩১৫বি নামে দু’টি সাব-ডিস্ট্রিক্ট গঠন করা হয়। লায়ন মোসলেম আলী খান এবং লায়ন শফিউর রহমান যথাক্রমে এ দুটি শাখার প্রথম ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নিযুক্ত হন।

বাংলাদেশে লায়ন আন্দোলনের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৯৯৫-৯৬ সালে সেগুলিকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে লায়ন ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫এ কে পুনরায় দু’ভাগে বিভক্ত করে ৩১৫এ-১ ও ৩১৫এ-২ নামকরণ করা হয়। লায়ন জাকের আহমদ এবং লায়ন এ আর আতিক যথাক্রমে নবসৃষ্ট এ দুটি ডিস্ট্রিক্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর নিয়োজিত হন। এর আগে ১৯৯৩-৯৪ সালে ৩১৫বি ডিস্ট্রিক্ট বিভক্ত করে ৩১৫বি-১ এবং ৩১৫বি-২ ডিস্ট্রিক্ট গঠন করা হয়। আতাউল করিম ৩১৫বি-১ ডিস্ট্রিক্ট এবং কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ ৩১৫বি-২ ডিস্ট্রিক্টের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর ছিলেন। ১৯৯৬-৯৭ সালে কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে লায়ন ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি-১ কে ভেঙ্গে নতুন আরেকটি ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি-৩ গঠন করা হয়। আহসান নাজির এই ডিস্ট্রিক্টের প্রথম গভর্নর নির্বাচিত হন। পরের বৎসর অর্থাৎ ১৯৯৭-৯৮ সালে একই প্রয়োজনে ৩১৫বি-২ ডিস্ট্রিক্ট বিভক্ত করে লায়ন ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি-৪ গঠিত হয়-এর প্রথম গভর্নর হয়েছিলেন লায়ন আব্দুল গাফফার দোভাষ। বর্তমানে বাংলাদেশে লায়ন আন্দোলন কার্যক্রম একটি মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট এবং ৬টি ডিস্ট্রিক্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এগারো হাজারেরও অধিক লায়ন সদস্য এবং প্রায় তিনি হাজার লিও এতে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। উল্লেখ্য, লায়ন্স ক্লাবগুলির সাথে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে পৃথকভাবে লিও ক্লাবগুলিকে সংগঠিত করা হয়।

লায়ন্স কাবগুলির সেবা কার্যক্রম ও বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকায় ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ লায়ন্স ফাউন্ডেশন (বিএলএফ) প্রতিষ্ঠা। এই ফাউন্ডেশন একটি আশি শয্যার বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতাল ও স্নাতকোত্তর চক্ষু চিকিৎসা ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে আসছে। দেশের ৬টি লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট এর শীর্ষ সংগঠন মাল্টিপাল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অংশে সংশ্লিষ্ট ডিস্ট্রিক্ট ও কাবগুলির সেবা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত প্রকল্পগুলির মধ্যে নরসিংদীর লায়ন্স প্রোগ্রেসিভ আই হসপিটাল, টাঙ্গাইলে লায়ন নজরুল ইসলাম কলেজ এবং ব্রা‏ণবাড়িয়ার লায়ন ফিরোজুর রহমান রেসিডেনশিয়াল একাডেমি উল্লেখযোগ্য।

সকল লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট এলাকায় মানবিক সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি ইউনিটের পৃথক পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫এ-১ এর আওতাধীন এলাকায় যশোরে কপোতাক্ষ লায়ন্স আই হসপিটাল, খুলনা লায়ন্স হাইস্কুল, দিনাজপুরে ডিস্ট্রিক্ট আই হসপিটাল, রংপুরে লায়ন্স শিশু নিকেতন এতিমখানা এবং লায়ন্স স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং সৈয়দপুরে সৈয়দপুর লায়ন্স হাইস্কুল পরিচালিত হচ্ছে। ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি-১ এর আওতায় রয়েছে সিলেটে মাদার এ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার (সাফা হাসপাতাল) এবং ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫বি-৪ এর অধীনে চট্টগ্রামে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের চক্ষু হাসপাতালটি ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম লায়ন্স ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেবামূলক কার্যক্রমের বাইরে বাংলাদেশের লায়ন্স ক্লাবগুলির অন্যতম সাফল্য হচ্ছে এম আর সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ঢাকায় ১৯৮৯ সালে ১৭তম আফ্রিকা ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের লায়ন্স ফোরাম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা।

সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে বর্তমানে প্রায় ৪৬০টি লায়ন্স রোটারী ক্লাব তৎপর রয়েছে। এগুলির এগারো হাজারেরও বেশি নারী এবং পুরুষ সদস্য লায়ন্স আন্দোলনের আদর্শ বাস্তবায়নে নিবেদিত রয়েছেন। এ সকল সদস্যদের চাঁদা বাবদ প্রদত্ত কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বিশেষ করে নিরক্ষতা দূরীকরণ ও অন্ধত্ব নিবারণের কাজে ব্যয় করা হয়। অসংখ্য মানবসেবাধর্মী কর্মতৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশে লায়নবাদ দিনদিন জোরদার হচ্ছে।  [শাহজাহান খাদেম]