লাখেরাজ

লাখেরাজ আরবি শব্দ, অর্থ নিষ্কর। মুগল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি অথবা কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। হিন্দু শাসনামলেও বিভিন্ন কারণে অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তিদের রাজকীয় কর্তৃত্ব দ্বারা নিষ্কর ভূমি অনুদান প্রদানের নিয়ম প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তীর্থস্থান, মন্দির ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত ছিল। মুগল শাসকদের অধীনে এই ঐতিহ্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। ১৭৭৬ সালের আমিনি কমিশনের মতে, সাম্রাজ্যের  রাজস্ব ভূমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন শ্রেণির লাখেরাজদের অনুকূলে পতিত হয়েছিল। তখন সরকারি দলিলে লাখেরাজ ভূমিকে বলা হতো বাজে জমি অর্থাৎ যেসব জমি বা জলাশয় থেকে সরকার কোন রাজস্ব পায় না।

ব্রিটিশ শাসনের প্রথম থেকেই বাজে জমি পুনর্দখলের চেষ্টা করা হয়। অধিক হারে ভূমি রাজস্ব আদায়কারী উপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রকৃতি ছিল লাখেরাজ প্রথার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু উক্ত বরাদ্দপ্রাপ্ত জমির মালিকদের তীব্র বিরোধিতার জন্য সরকার তার রাজস্ব নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় এবং যেসব জমি অবৈধভাবে নিষ্কর ভূমে রূপে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, শুধু সেসব জমি পুনর্দখল করা হয়। ১৭৯৩ সালের ১৯ এবং ৩৭ নং রেগুলেশন অনুসারে সকল লাখেরাজদারদের তাদের সনদ যাচাইকরণ ও নিবন্ধনকরণের জন্য কালেক্টরের অফিসে পেশ করার আইন করা হয়। ১৮২২ সালে সরকার অবৈধভাবে হস্তান্তরিত সকল জমির জরিপ পরিচালনা এবং তা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লাখেরাজ ভূমি বাজেয়াপ্ত অভিযানের ফলে বহুসংখ্যক লাখেরাজ সনদ বাতিল হয়ে যায়। আর মুসলমানগণ ছিলেন লাখেরাজদারদের মধ্যে সর্বাধিক। এই অভিযান ১৮৪০ সালে শেষ হয় এবং উত্তরাধিকারী কর্তৃক দাবি করা না হলে তখন থেকে কোন নিষ্কর বা লাখেরাজ জমি আর কখনও সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়নি।

লাখেরাজ ভূমির মধ্যে রয়েছে পীর বা সুফি স্থাপনাসমূহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূমি, ব্রহ্মোত্তর স্থাপনাসমূহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূমি, আয়মা বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ভূমি, চেরাগি বা তীর্থস্থানসমূহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূমি, মদত-ই-মাস বা শিক্ষা ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠানসমূহের সহায়তার জন্য ভূমি। আইনমতে, লাখেরাজ ভূমির উত্তরাধিকারীরা ভূমি ভোগদখল করতে পারেন, কিন্তু সরকারের অনুমোদন ছাড়া তা হস্তান্তর করতে পারেন না। করমুক্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক জেলা কালেক্টরকে বি-রেজিস্টার নামে একটি ধারাবাহিক রেজিস্টারে লাখেরাজ ভূমির বিস্তারিত তথ্যাদি বা রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হতো এবং এখনও করা হয়। এই রেজিস্টারে সর্বশেষ লাখেরাজ অধিকার ভোগকারীদের তথ্যাদি রেকর্ড করা হতো। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে সকল লাখেরাজ অনুদান দেখাশুনা করার দায়িত্ব অর্পিত হয় কোর্ট অব ওয়ার্ডস্-এর ওপর। কোনো লাখেরাজ ভূমি গ্রহীতাদের মধ্যে তাদের নিজ নিজ অধিকার ও দায়দায়িত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে কোর্ট অব ওয়ার্ডস্কে তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। বর্তমানে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ভূমি সংস্কার বোর্ড কেন্দ্রীয়ভাবে লাখেরাজ ভূমির ব্যবস্থাপনা করে থাকে।  [সিরাজুল ইসলাম]