লবণাক্ত মৃত্তিকা

লবণাক্ত মৃত্তিকা (Saline Soil)  লবণ দ্বারা প্রভাবিত এক প্রকার মৃত্তিকা যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রবণীয় লবণ, বিশেষ করে সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে। অন্যভাবে বলা যায় যে, সোডিয়াম সংবলিত লবণের ইলেকট্রোলাইটের প্রভাবাধীনে উৎপন্ন মৃত্তিকা। এসব মৃত্তিকার বিক্রিয়া বা পিএইচ নিরপেক্ষ মানের কাছাকাছি থাকে। লবণাক্ত মৃত্তিকাতে বিদ্যমান প্রধান লবণগুলো হলো সোডিয়াম সালফেট, সোডিয়াম ক্লোরাইড ও কদাচিৎ সোডিয়াম নাইট্রেট, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড। এসব মৃত্তিকা  সোডিক মৃত্তিকা (বিনিময়যোগ্য কমপে­ক্সে সোডিয়াম সম্পৃক্তি ১৫ শতাংশের অধিক এবং পিএইচ ৮.৫-এর বেশি হতে পারে) নয়। মৃত্তিকাতে দ্রবণীয় লবণের পরিমাণ ততোটাই যা অধিকাংশ শস্যের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। মৃত্তিকাতে দ্রবণীয় লবণের পরিমাণ শতকরা হার বা মিলিয়নের অংশ বা অন্য কোনো সুবিধাজনক একক যেমন- মিলিমোহজ/সেন্টিমিটার (mmhos/cm) বা মিলিসিমেন্স/ সেন্টিমিটার (ms/cm) প্রকাশিত বিদ্যুৎ পরিবাহিতা (Ec) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। সম্পৃক্ত লবণাক্ত মৃত্তিকার পিএইচ মান সাধারণত ৮.৩-এর চেয়ে কম। এসব মৃত্তিকা ভৌগোলিকভাবে শুষ্ক, শুষ্ক-প্রায়, অর্ধ-আর্দ্র এবং আর্দ্র অঞ্চলে পাওয়া যায়।

thumb

আনুমানিক হিসাব থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ২.৮ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি লবণাক্ততা এবং নিকৃষ্ট মানের পানি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। এ এলাকাতে ব-দ্বীপীয় পললভূমি, পাহাড় ও নগর এলাকা এবং জলাধার অন্তর্ভুক্ত। লবণাক্ততা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বাংলাদেশের মোট এলাকার প্রায় এক পঞ্চমাংশ এবং এলাকাটি বঙ্গোপসাগরের উত্তর শীর্ষবিন্দু বেষ্টন করে অবস্থিত। লবণাক্ত মৃত্তিকাগুলো প্রধানত উপকূলীয় খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা এবং সমুদ্রতীর থেকে দূরবর্তী ভূমিতে পাওয়া যায়।

পরিবেশগত বেশ কিছু সংখ্যক নিয়ামকের কারণে উপকূলীয় মৃত্তিকাগুলোর পৃষ্ঠ, অঃপৃষ্ঠ স্তর এবং অন্তঃস্তরের লবণাক্ততা যথাক্রমে মৃদু, মধ্যম ও অধিক হয়ে থাকে। লবণ সঞ্চয়নের প্রক্রিয়াটিকে লবণায়ন (salinisation) বলা হয়। কোন এলাকা, বিশেষ করে অবস্থানের উপর নির্ভর করে উপকূলীয় এলাকাতে লবণায়নের জন্য বেশ কিছু সংখ্যক নিয়ামক কাজ করে। ভূমির বন্ধুরতা এবং প­াবনের মাত্রা প্রধানত বাংলাদেশের উপকূলীয় লবণাক্ত মৃত্তিকার উৎপত্তিকে প্রভাবিত করে। অন্যান্য নিয়ামকগুলো হলো: (ক) মৃত্তিকার প্রকৃতি, (খ) বৃষ্টিপাত, (গ) জোয়ারভাটার প্রভাব, (ঘ) নদীপ্রণালী ও এদের প্রবাহের প্রভাব, (ঙ) ভূজল-পৃষ্ঠের গভীরতা ও লবণ অবক্ষেপ এবং (চ) ভূমির ঢাল ও নিষ্কাশন খাতের নৈকট্য।

পললভূমি অবক্ষেপে সাধারণত কেওলিনাইট ও ইলাইটের বিভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণের এঁটেল মণিক থাকে। গঙ্গা কটাল ও নদীজ এবং নবীন মেঘনা মোহনাজ পললে কেওলিনাইট ও ইলাইট ছাড়াও অধিক পরিমাণে মন্টমরিলে­ানাইট আছে। আর্দ্র ও শুষ্ক মৌসুমের বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবনের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য থেকে দেখা গিয়েছে যে, উপকূলীয় মৃত্তিকার পৃষ্ঠস্তরের লবণায়নের কারণ হলো শুষ্ক মৌসুমের নিট ঋণাত্মক বাষ্পীভবন। উপকূলীয় এলাকা ঘূর্ণিঝড় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেই সঙ্গে প্রায়ই সাগরের পানি দ্বারা প­াবিত হয়। জলোচ্ছ্বাসের পরিসর ক্যামেরুন অন্তরীপে শূন্য থেকে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পয়েন্টে প্রায় ৬ মিটার। এ ধরনের জলোচ্ছ্বাস মৃত্তিকাকে দ্রবণীয় লবণ দ্বারা সম্পৃক্ত করে। উপকূলীয় বলয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা ও এর শাখানদীসমূহ যেমন: গড়াই-মধুমতি ও বলেশ্বর এতদঞ্চলে লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রায় বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে যে, খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা ১,০০০ মাইক্রোমোহজ/ সেন্টিমিটারের নিচে বজায় রাখতে গড়াই নদীতে নিয়মিত সর্বোচ্চ ৫০০০ কিউসেক স্বাদু পানি প্রবাহের প্রয়োজন। ধারণা করা হয় যে, মেঘনা নদীর বর্তমান প্রবাহ ৭,০০০ ঘনমিটারের চেয়ে হ্রাস পেলে লবণ পানির অনুপ্রবেশ জনিত সমস্যা উলে­খযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।

উপকূলীয় মৃত্তিকা মৃদু থেকে মধ্যম লবণাক্ত, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। অধিক পলিময় মোহনাজ পললভূমির পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তঃস্তরে লবণাক্ততার মান অধিক। সুন্দরবনের মৃত্তিকা পূর্ব দিকে প্রধানত মধ্যম লবণাক্ত থেকে লবণাক্ত এবং পশ্চিম দিকে অধিক লবণাক্ত (২০-৫৬ মিলিমোহজ/সেন্টিমিটার)। মৃত্তিকার লবণাক্ততা উত্তর-পূর্ব দিকে সর্বনিম্ন এবং পশ্চিম দিকে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। লবণাক্ততার মাত্রা ফেব্রুয়ারি মাসে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা দেখায় এবং এপ্রিল-মে মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। জুন মাসের পর মৃত্তিকার লবণাক্ততা দ্রুত হ্রাস পায় এবং পানির লবণাক্ততা  হ্রাস আরও বেশি দ্রুততার সঙ্গে ঘটে। [মোহাম্মদ খুরশিদ আলম]