রাজনৈতিক ভূগোল

রাজনৈতিক ভূগোল  কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের কালানুক্রমিক পরিসর, অবস্থান ও দূরত্ব এবং নির্দিষ্ট সময়কালে রাষ্ট্রের আয়তন ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বলয়ের বিবর্তন, আধিপত্য কিংবা অবক্ষয় সম্পর্কিত ধারণা।

বাংলার প্রাচীন যুগ  এককালের ‘বাঙ্গালা’, পরবর্তী সময়ের ‘বাংলা’ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার রূপান্তর বোঝাতে কতিপয় ভৌগোলিক, মানচিত্রগত, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যসূত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় গোড়ার দিকের বৈদিক সাহিত্যে। নিম্ন গাঙ্গেয় সমগ্র অঞ্চল প্রধানত বদ্বীপের পূর্বাংশ তৎকালে ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল। পুন্ড্র, প্রাচ্য, বিদেহ ও কিরাত নামে পরিচিত পার্শ্ববর্তী রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক ইউনিটগুলি প্রাক-আর্যযুগেও বিদ্যমান ছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আর্যদের আগমনের সময়ে (আনু. ১৫০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বঙ্গের অধিকাংশ এলাকাই ছিল অরণ্যভূমি এবং এখানে বসবাস করত প্রটো-অস্ট্রালয়েড জাতির আদিবাসীরা। পরবর্তী সময়ে যারা বৈদিক নামে পরিচিতি লাভ করে। তা সত্ত্বেও নদীমাতৃক ও অরণ্যবেষ্টিত বিধায় বঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি আর্যদের রাজ্যসীমার বাহিরে ছিল।

রামায়ণের যুগে (৭ম-৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) চিহ্নিত বাংলার ভৌগোলিক সীমানা সম্ভবত ব্রিটিশ আমলেও খুব বেশি বদলায় নি। বঙ্গ ও পুন্ড্র ছিল গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। পূর্বাঞ্চলে অঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিস্তার লাভ করে। সমুদ্র অভিমুখী গঙ্গা ও লোহিত (ব্রহ্মপুত্র) নদের সঙ্গমস্থলে জেগে ওঠে ‘লোহিত সাগর’ নামে একটি অঞ্চল এবং এর ঠিক দক্ষিণেই ছিল পূর্ব সমুদ্র বা আর্যাবর্ত। মহাভারতের যুগে (৫ম-২য় খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বঙ্গ নামের অঞ্চলটি অঙ্গ ও পুন্ড্রের তুলনায় ভিন্নতর ছিল।

বৌদ্ধযুগে বাংলা বর্তমানের উত্তর-মধ্য ভারত কিংবা প্রাচীন যুগের মধ্যদেশে কয়েকটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। আরও পূর্বদিকে প্রাচ্য নামে একটি বৃহৎ এলাকার অঙ্গীভূত হয়ে গঠিত হয় অঙ্গ, পুন্ড্র, সুঙ্গ এবং স্পষ্টত বঙ্গ। এছাড়া লোহিত সাগরের উত্তর-পূর্ব এলাকা জুড়ে প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের উত্থান ঘটে। অঙ্গ ও পুন্ড্রের একটি বড় এলাকা এবং বঙ্গের কিছু অংশ মগধের করতলগত হয় (আনু. ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্ব)। পরবর্তী সময়ে মৌর্যযুগে (৩২১-১৮১ খ্রিস্টপূর্ব) অঙ্গ, পুন্ড্র ও প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের তুলনায় ভৌগোলিক দিক থেকে বঙ্গ প্রাধান্য লাভ করে। বাণিজ্যপথ হিসেবে গাঙ্গেয় নিম্নাঞ্চলের বিস্তৃত নদীপথ ব্যবহারের ফলে উক্ত এলাকায় কয়েকটি নতুন নগর গড়ে ওঠার ফলেই সম্ভবত তা ঘটেছিল। উল্লেখ্য যে, এ সময় বঙ্গের অধিবাসীগণ নৌকানির্মাতা হিসেবে খ্যাত নাবিক একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ যুগটি বৌদ্ধধর্মের প্রসারের জন্যও প্রসিদ্ধ এবং বৌদ্ধরা পরিকল্পিত সড়ক, পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ, শহর ও মঠ/বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বৃহৎ নির্মাণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কুষাণ সাম্রাজ্য (আনু. ৩০০-১০০ খ্রিস্টপূর্ব) মগধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় অঙ্গ, বঙ্গ, সুঙ্গ ও পুন্ড্র তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অনেকটা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। তবে পুন্ড্র অঞ্চল পুন্ড্রবর্ধন নামে সর্বোচ্চ ভূ-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রধান্য লাভ করে, অন্যদিকে প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের গৌরব ক্রমশ হ্রাস পায়।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দ থেকেই গঙ্গারিদ্ধি ও প্রাচ্যের সেনানীদের বীরগাঁথা দিয়ে বাংলা বা বাঙ্গালার লিপিবদ্ধ ইতিহাসের সূচনা। আলেকজান্ডার এদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। কার্টিয়াস, প্লুটার্ক, সোলিনাস ও ডিয়োডোরাস - এদের সবাই একমত ছিলেন যে গঙ্গারিদ্ধি ও তার জনসাধারণ গঙ্গার পূর্বদিকের অধিবাসী। ডিয়োডোরাস উল্লেখ করেন যে, ভারতে বহু জাতির বাস এবং তন্মধ্যে গঙ্গারিদ্ধির জনসংখ্যাই সর্বাধিক। অন্যদিকে Periplus of the Erythrean Sea  গ্রন্থে প্রাসী নামে যে অঞ্চল উল্লিখিত তা পুন্ড্র-অধ্যুষিত পূর্বদেশ হতে পারে। কিন্তু গঙ্গারিদ্ধি হিসেবে বাংলার প্রথম মানচিত্রগত বিবরণে সমগ্র বঙ্গ ও অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু তাতে সুনির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নির্দেশিত হয়নি।

হর্ষ-শশাঙ্ক রাজত্বের অন্তর্বর্তীকালীন বাংলা  এ যুগে (আনু. ৫০০-৭০০ খ্রিস্টাব্দ) বাঙ্গালার দক্ষিণ-পশ্চিম (বর্তমান উড়িষ্যা) অঞ্চলে শশাঙ্ক এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে (আসামের কামরূপ) বর্মনরা ব্যাপক রাজনৈতিক আধিপত্য লাভ করে। রাজা শশাঙ্ক গৌড় আক্রমণ করলে তার সম্প্রসারণ নীতিতে ভীত কামরূপের ভাস্করবর্মন তৎকালীন উত্তর ভারতের শাসক হর্ষবর্ধনের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হন। এভাবেই হর্ষবর্ধন পুন্ড্রবর্ধনে অনুপ্রবেশের সুযোগ লাভ করেন। এ যুগের গোড়ার দিকে পূর্বে লোহিত সঙ্গমস্থল থেকে পশ্চিমে গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত সমতটের কাছে বাংলা হীনশক্তি হয়ে পড়ে। কামরূপ তখন ছিল পুন্ড্রবর্ধন এমনকি মগধের প্রাধান্য ম্লান করে দেওয়ার মতো বিশাল এক রাজ্য। হর্ষ-শশাঙ্ক রাজত্বের অন্তর্বর্তীকালে ভারতে সফররত চীনা পরিব্রাজকদের কেউ কেউ বাংলাও সফর করেন। তাদের লিখিত বিবরণ থেকে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মানববসতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এ যুগে বাঙ্গালায় বৌদ্ধধর্মের প্রসারের ফলে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে এবং উত্তর ভারতে গুপ্তদের রাজনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।

পালযুগে বাংলা এ যুগে (আনু. ৭০০-৯২৫ খ্রি.) সমগ্র এশিয়া ও বাংলায় বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে। এযুগের শেষের দিকে আরব মুসলমানরা পশ্চিম ভারত জয় করে নেয় এবং পূর্বদিকে ইসলাম ধর্মের স্বতঃস্ফুর্ত ও শান্তিপূর্ণ বিস্তার ঘটে। লক্ষ্য করা যায় যে, পূর্ববর্তী যুগে রাজনৈতিক বৈরিতা ও স্থানীয় যুদ্ধবিগ্রহের দরুন বাঙ্গালায় অনেকগুলি রাজ্যের উত্থান ও পতন ঘটে এবং তা গুপ্তযুগের শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। গোপাল আট শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের কয়েকটি এলাকা নিয়ে পাল বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের অবস্থান সুসংহত এবং বাংলার শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। পশ্চিমে পাল রাজারা বিশেষত রাজা গোপাল বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সেনযুগে বাংলা পালযুগে বাংলায় স্থিতিশীল অবস্থা বিদ্যমান থাকলেও রাজা প্রথম মহীপাল (৯৯৫-১০৪৩ খ্রি.) এবং রামপালের রাজত্বকালে (১০৮২-১১২৪ খ্রি.) চান্দেলা, কোল, চালুক্য ও কালাচুরিদের সঙ্গে প্রায়ই যুদ্ধ ও সংঘাত লেগে থাকত। পাল রাজত্বের শেষদিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও গোত্রীয় কোন্দল এই বিশাল রাজ্যকে হীনবল করে দেয়। এ নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সেন রাজারা মগধ, বঙ্গ, পুন্ড্র ও সমতট অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে এবং ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করে। বাংলার বিকাশমান বৌদ্ধধর্ম সেনদের হাতে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়। এই কালপর্বে আরব ও পারস্য থেকে আগত মুসলমান বণিকদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মপ্রচারকগণ সমুদ্রপথে সমতট ও আরাকানে পৌঁছেন এবং সেনদের নিগ্রহ এড়ানোর জন্য বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলামধর্ম গ্রহণ শুরু করে।

তুর্ক-আফগান শাসনে বাংলা ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির কাছে সেনদের পরাজয় ঘটে। তিনি ছিলেন সম্ভবত অযোধ্যার শাসকের অধীনস্থ একজন ক্ষুদ্র জায়গিরদার। এই ভাগ্যান্বেষীর প্রচন্ড আক্রমণে রাজা লক্ষ্মণসেন পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে পালিয়ে যান এবং সেখানে ১২৪৫ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তী সেন রাজারা বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ১২৮৯ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য অব্যাহত রাখেন। অবশেষে মুসলমান সুলতানদের সময় বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।

মুগল আমলে বাংলা বাংলায় মুগলদের আগমন ঘটে অপেক্ষাকৃত বিলম্বে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর। যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার সীমানা ১৬১২ ও পরে ১৬৬১ সালে পূর্বদিক কুচবিহার এবং ১৬১২-৬৩ সালের মধ্যে অহোম ও আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পশ্চিমের সীমানা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। এই সীমানা কোনো কোনো সময় বিহার-ঝাড়খন্ডের পশ্চিম সীমানা এবং দক্ষিণে উড়িষ্যার উত্তর সীমানার সঙ্গে মিশে যেত। এ সময় সমগ্র বাঙ্গালায় মুসলিম সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বেশ কিছু নগরের পত্তন হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাটনা, মুঙ্গের, পান্ডুয়া, মুর্শিদাবাদ, সোনারগাঁ, শ্রীহট্ট, বাগেরহাট, চাটিগাঁ ও সন্দ্বীপ।

উপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা ব্রিটিশ জরিপকর্মী জেমস রেনেল (১৭৮৪) অঙ্কিত মানচিত্রে বাঙালাকে বেঙলা বলা হয়েছে। এই মানচিত্র অনুযায়ী এই রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা পশ্চিমে অযোধ্যা ও বিহারের বারাণসী সীমান্তবর্তী এবং পূর্বে আসামের নিম্নাঞ্চল ও সিলেট, উত্তরে নেপাল ও ভুটান সীমান্ত থেকে উড়িষ্যার উত্তর-সীমান্তে মেদিনীপুর এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুগল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে বর্ধমানে ব্যবসা ও বসতি স্থাপনের সুযোগে ব্রিটিশরা স্থানীয় শক্তিগুলির সঙ্গে নানা ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় এবং ফলত ১৯৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবকে পরাজিত করে। অতঃপর বাংলার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কার্যত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। ১৭৬৫ সালে মুগল সম্রাট তাদের সুবা বাঙলার দেওয়ানি অধিকার প্রদান করলে তাদের অবস্থান আরও মজবুত হয়ে ওঠে। দেওয়ানি অধিকারের ফলে কোম্পানি রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা অর্জন করে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন ভারতের সমগ্র এলাকায় প্রশাসনকে মোটামুটি একটি একক কাঠামোর আওতায় আনা হয়। বাংলায় ভৌগোলিক এলাকা, যা ছিল আকারে পালযুগের বাংলার সঙ্গে তুলনীয়, ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’র অন্তর্ভূক্ত হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে আরও অন্তর্ভুক্ত হয় বিহার, উত্তর-পূর্ব উড়িষ্যার একাংশ, গোটা আসাম ও আরাকানের এক ক্ষুদ্রাংশ। পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি আদিবাসী রাজ্য বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ব্রিটিশ রাজের শাসনের শুরুতে অংশত রাজনৈতিক, অংশত প্রশাসনিক কারণে অনেকগুলি আঞ্চলিক ও সীমানাগত পরিবর্তন ঘটান হয়। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল প্রশাসনিক সংস্কারের নামে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। নতুন গড়ে ওঠা প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসাম ছিল ইয়েটস (ভারতীয় আদমশুমারি কমিশনার) প্রণীত ১৯০১ সালের ২৭৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এবং প্রায় ৩ কোটি ১০ লক্ষ জনসংখ্যাসহ (৫৯.৩% মুসলমান, ৩৯.০% হিন্দু এবং ১.৭% অন্যান্য) ‘নদী অববাহিকা পরিকল্পনার’ সঙ্গে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদে বাধ্য হয়। এ পর্যায়ে প্রধানত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ  এবং আসামকে একটি পৃথক প্রদেশ করা হয়। বিহার ও উড়িষ্যা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু বাংলা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলার পশ্চিম অংশে হিন্দুদের এবং পূর্ব অংশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাংলা বিভাগের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের এক আপাত সমাপ্তি ঘটে। র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ নামে পরিচিত এই বিভাগ ছিল মূলত সম্প্রদায়গত আবাসভিত্তিক। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলি পাকিস্তানভুক্ত হয়।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আবার নতুন করে পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের যে পূর্বাংশ পূর্ববাংলা নামে পরিচিত ছিল তা প্রধান বন্দর (কলকাতা) রেলপথ ও যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল এবং পাটজাত সামগ্রী প্রক্রিয়াকরণের প্রধান শিল্পাঞ্চল হারায়।

ভারত বিভাগ এ অঞ্চলে জনবসতির ভৌগলিক কাঠামোতে বহুমুখী প্রভাব ফেলে। বিভাগের পর ভারত থেকে ২০ লক্ষ শরণার্থী পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নেয় এবং ১০ লক্ষ ভারতে চলে যায়। ভারত বিভাগ মানুষের বসতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে শরণার্থীদের বসবাস শুরু করার সময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও এ অঞ্চলে বেশ কিছু শিল্প-উদ্যোক্তার আগমন ঘটে। আমলা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অধিকাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। ভাষার প্রশ্ন নিয়েও অতিরিক্ত জটিলতা দেখা দেয়। এসব কারণে পূর্ব পাকিস্তানে বিরোধের এক নতুন পর্যায় সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য জাতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভক্ত করে ফেলে। বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং পরিণতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।  [কে. মউদুদ এলাহী]

গ্রন্থপঞ্জি  Sirajul Islam (ed), History of Bangladesh 1704–1971, Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka, 1998; H Rashid, Geography of Bangladesh, Dhaka, 1991; S Chattopadhyaya, The Periplus of Erythrean Sea and Medieval India, New Delhi, 1980; J Rennell, Memoir of a Map of Hindoostan on the Mughal Empire, Calcutta, 1979; DC Sarker, Studies in the Geography of Ancient and Mediaeval India, Delhi,1971. RC Majumdar, The History of Bengal, Dhaka, 1963.