রজনীকান্ত সাহিত্যাচার্য

রজনীকান্ত সাহিত্যাচার্য (১৮৬৯-১৯২৯)  সংস্কৃত পন্ডিত, কবি। চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা কালীকিঙ্করও ছিলেন একজন সংস্কৃত পন্ডিত এবং স্মৃতিশাস্ত্রে পান্ডিত্যের জন্য তিনি ‘স্মৃতিভূষণ’ উপাধি লাভ করেন।

রজনীকান্ত পিতার চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন করে ‘সাহিত্যাচার্য’ উপাধি লাভ করেন এবং স্বপ্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন; পরে তিনি এর অধ্যক্ষ হন। শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামে  চট্টল ধর্ম মন্ডলীসভা এবং ‘ব্রহ্মবিদ্যা বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কলকাতা সংস্কৃত অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কার্যনির্বাহক ছিলেন।

রজনীকান্ত সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ভাষায় কাব্য রচনা করেন। তাঁর সংস্কৃত গ্রন্থগুলি: বিবুধবিনোদনম্, চট্টলাবিলাপম্, বিদ্যাশতকম্, মঙ্গলোৎসবম্ ইত্যাদি; আর বাংলা গ্রন্থগুলি হলো: ব্রহ্মযজ্ঞ, ঋষিসঙ্গীত, রজনীসঙ্গীত, অবসানসঙ্গীত, প্রাণের কথা। চট্টলাবিলাপম্ (১৯০৯) কাব্যটি কবি নবীনচন্দ্র সেনের প্রয়াণ উপলক্ষে ৮৪টি শ্লোকে রচিত। এতে শোকাচ্ছন্ন মানুষ ও প্রকৃতির অন্তর্বেদনার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।  [সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী]

রজনীকান্তের গান  কান্তগীতি নামে পরিচিত। আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে পঞ্চ গীতিকবিদের অন্যতম ছিলেন রজনীকান্ত। রবীন্দ্রপ্রভাবে প্রভাবিত হয়েও তিনি যে গানগুলি রচনা করেছেন তা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

রজনীকান্তের গানের মুখ্য বিষয় ঈশ্বরভক্তি। সরল সৌকর্যপূর্ণ শব্দের বুননে ঈশ্বরস্ত্ততিমূলক এই গানগুলি হূদয় মথিতকরা উপাদানে সমৃদ্ধ। ঈশ্বরের উদ্দেশে তাঁর প্রার্থনামূলক একটি বিখ্যাত গান: ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।’ এতে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, শোক-তাপ এবং পাপ মোচনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আরও কয়েকটি জনপ্রিয় গান হলো: ‘আমিতো তোমারে চাহিনি জীবনে’, ‘কেন বঞ্চিত তব চরণে’, ‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছ’, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ প্রভৃতি। গানগুলির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও আত্মনিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি প্রকাশ পেয়েছে জীবন ও জগতের প্রতি তাঁর বৈরাগ্যভাবনা।

ভক্তিভাব ছাড়াও রজনীকান্তের অনেক গানে দেশাত্মবোধ ও হাস্যরসের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন রজনীকান্তকে যে দেশাত্মবোধে উদ্দীপিত করেছিল তার প্রকাশ দেখা যায় ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, মাথায় তুলে নেরে ভাই’ গানটিতে। সেকালে গানটি প্রায় সর্বত্রই জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের, বিশেষ করে শিক্ষার্থী যুবকদের কণ্ঠে গীত হতো। রজনীকান্ত হাস্যরসাত্মক গান রচনায় উদ্বুদ্ধ হন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রভাবে। তাঁর রচিত প্রেম ও প্রকৃতিবিষয়ক গানের সংখ্যাও কম নয়।

রজনীকান্তের গান বাংলার মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদানে সমৃদ্ধ।  কীর্তনবাউলরামপ্রসাদীপাঁচালি ইত্যাদি গানের সুর ও ভাবের প্রভাব তাঁর গানে লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখ গীতিকারের মতো বিলেত যাওয়ার বা বড় কোনো ওস্তাদের নিকট গান শেখার সুযোগ তাঁর হয়নি। তাই কান্তগীতির সুরে কিছুটা বৈচিত্র্যের অভাব পরিলক্ষিত হলেও ভক্তিভাবের সহজ অভিব্যক্তিতে তা হূদয়গ্রাহী। সঙ্গীতের বিবিধ কারুকাজ তাঁর গানে না থাকলেও গানের সহজ ভাবপূর্ণ কথার সঙ্গে মিড়ের টানযুক্ত সুরের আবেদন শ্রোতাকে আকর্ষণ করে।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যমগুলিতে তাঁর গান নিয়মিত গীত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্যসূচিতেও কান্তগীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও রজনীকান্তের গান বিশেষভাবে পরিচিত এবং জনপ্রিয়।  [খান মোঃ সাঈদ]

গ্রন্থপঞ্জি  করুণাময় গোস্বামী, সঙ্গীতকোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫; সুধীর চক্রবর্তী, বাংলাগানের সন্ধানে, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ (১৯৯০)।