যৌথ নদী কমিশন

যৌথ নদী কমিশন (Joint Rivers Commission)  ১৯৭২ সালে ঢাকায় বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর শেষে ১৯ মার্চ, ১৯৭২ তারিখে যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের জুন মাস থেকেই যৌথ নদী কমিশন (জে.আর.সি) তার কার্যক্রম শুরু করলেও এর কার্যবিধি ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের নয়াদিল্লীতেও অনুরূপ একটি যৌথ নদী কমিশন রয়েছে।

জে.আর.সি-এর কার্যবিধি অনুসারে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন চেয়ারম্যান এবং তিনজন সদস্য সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হবে এবং সদস্য তিনজনের মধ্যে দুইজনই হবেন প্রকৌশলি। সরকার প্রয়োজন বোধ করলে বিশেষজ্ঞ এবং উপদেষ্টাও নিয়োগ দিতে পারেন। বাংলাদেশ এবং ভারত পালাক্রমে এক বছরের জন্য কমিশনের সভাপতিত্ব করবে। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দুই দেশের কর্মকর্তাবৃন্দের মধ্য থেকে দুই দেশের জন্য চেয়ারম্যান মনোনীত করা হতো, কিন্তু এর পর থেকে কমিশনের চেয়ারম্যান পদটি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। একদল প্রকৌশলি, বিজ্ঞানী এবং কর্মচারী জে.আর.সি-এর কার্যালয়ের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কাজকর্ম এবং সাচিবিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। ২০০০ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত জে.আর.সি-এর কার্যালয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি অনুসন্ধান অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। কিন্তু ২৮ জুন ২০০০ তারিখ থেকে কমিশন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

ভারতের সঙ্গে ৫৪টি এবং মায়ানমারের সঙ্গে ৩টি সহ মোট ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে জে.আর.সি কাজ করে থাকে। যৌথ নদী কমিশন এ সকল আন্তঃসীমান্ত নদীর উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকে যে উপাত্তগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংরক্ষিত তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কার্যবিধি অনুসারে যৌথ নদী কমিশনের কার্যক্রমসমূহ হচ্ছে: উভয় দেশের সাধারণ নদীপ্রণালী থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করার লক্ষ্যে অংশীদার দেশসমূহের মধ্যে সর্বাধিক কার্যকর লিয়াজোঁ রক্ষা করা; বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম প্রণয়ন করা এবং যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নে সুপারিশ করা; বিস্তারিত আগাম বন্যা সতর্কীকরণ, বন্যা পূর্বাভাস এবং ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা; দুই দেশের জনগণের সমতাভিত্তিক পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে এতদঞ্চলের পানি সম্পদ ভোগ করার লক্ষ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ  প্রকল্পসমূহ সমীক্ষা করা; উভয় দেশে সৃষ্ট বন্যা সমস্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা। এছাড়াও উভয় দেশের সরকারের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে নির্দেশিত যে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করাও যৌথ নদী  কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব।

যৌথ নদী কমিশনের অন্যান্য প্রধান দায়িত্বসমূহের মধ্যে রয়েছে: আন্তর্জাতিক অথবা আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহের পানি সম্পদ উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা এবং বণ্টনের লক্ষ্যে প্রতিবেশি দেশসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা; জে.আর.সি, যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি, ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টনের যৌথ কমিটি, স্ট্যান্ডিং কমিটির নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠান করা; স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং স্থানীয় পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহের সমস্যা পুনর্সমাধান করা; ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কায় প্রাপ্ত গঙ্গার পানির বণ্টন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান এবং বাস্তবায়ন করা; আগাম বন্যা সতর্কীকরণ, বন্যা পূর্বাভাস এবং ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণের ওপর বিস্তারিত প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা এবং এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত বিনিময়ের লক্ষ্যে ভারত ও নেপালের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা; ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদীসমূহের পানি ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর সমন্বিত গবেষণা ও সমীক্ষাকার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে ভূটানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা।

যৌথ নদী কমিশনের কার্যক্রমসমূহ  জে.আর.সি-এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২৫-২৬ জুন তারিখে নয়াদিল্লীতে। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং জে.আর.সি-এর প্রথম চেয়ারম্যান জনাব বি.এম আববাস এ.টি। বৈঠকে ভারতীয় পক্ষে ছিলেন জে.আর.সি-এর তৎকালীন কো-চেয়ারম্যান এন.জি.কে মুর্তি। পরবর্তী বছরগুলোতে জে.আর.সি-এর প্রধান কার্যক্রমসমূহ গঙ্গা, তিস্তা এবং অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানিতাত্ত্বিক উপাত্ত  বিনিময়ের ওপর নিবদ্ধ ছিল।

গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কিত কার্যক্রম  ভারত কর্তৃক নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের ফিডার খাল চালু রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিল তারিখে ঢাকা ও নতুন দিল্লীর যৌথ ইশতেহারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির কথা ঘোষিত হয়। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় ফারাক্কা পয়েন্টে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মেয়াদ ছিল ৫ বছর। ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর ভারতের নতুন দিল্লীতে উভয় দেশের মধ্যে দুই বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮৫ সালের ২২ নভেম্বর উভয় দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কিত অপর একটি ৩ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে যৌথ নদী কমিশনের সফল উদ্যোগের ফলে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন দিল্লীতে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে ফারাক্কায় দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কিত ৩০ সালা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা উভয় দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পুনরায় নবায়নযোগ্য।

তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কিত কার্যক্রম  ১৯৮৩ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় জে.আর.সি-এর ২৫তম বৈঠকে শুষ্ক মৌসুমে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানির এডহক বণ্টনে উভয় দেশ সম্মত হয়। এই এডহক বণ্টন ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে এই এডহক বণ্টনের মেয়াদ ১৯৮৭ সালের শেষ পর্যন্ত বর্ধিত হয়। ১৯৮৭ সালের ১১ মে জে.আর.সি-এর ২৯তম বৈঠকে উভয় দেশ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশের কালীগঞ্জ থেকে ভারতের ঝাড়সিঙ্গেশ্বর পর্যন্ত তিস্তা নদীর ডানতীর ভেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ ১৯৯৮ সালের জুন মাসের মধ্যে সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যৌথ নদী কমিশন ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে চীন, নেপাল এবং ভূটানের সঙ্গে সমীক্ষা ও গবেষণাকার্য পরিচালনা করে। ফেব্রুয়ারি ২০০২ পর্যন্ত যৌথ নদী কমিশনের ৩৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ৩৪তম বৈঠকটি ১২-১৩ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।  [এইচ.এস মোজাদ্দাদ ফারুক]

আরও দেখুন ফারাক্কা বাঁধ; গঙ্গার পানিবণ্টন