যমুনা নদী

যমুনা নদী  ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বাংলাদেশের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের দীর্ঘতম নদীসমূহের মধ্যে অন্যতম। তিববত, চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের ভূখন্ড জুড়ে রয়েছে এর অববাহিকা অঞ্চল। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদের নিম্ন প্রবাহ যমুনা নামে অভিহিত। ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে সংঘটিত ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যার ফলে ব্রহ্মপুত্রের তৎকালীন গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কালের যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদ তার পুরানো গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণাভিমুখী যমুনা নদী নামে প্রবাহিত হয়ে আরিচায় গঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রবাহ প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিণপূর্বাভিমুখী ব্রহ্মপুত্রের পুরানো প্রবাহটি শীর্ণকায় হয়ে পড়ে এবং অদ্যবধি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহমান রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগ ব্রহ্মপুত্রের বর্তমান সমগ্র প্রবাহকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নামে অভিহিত করে থাকে।

তিববতের মানস সরোবর এবং কৈলাস পর্বতের মধ্যবর্তী পার্খা নামক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে ১৪৫ কিমি অদূরে অবস্থিত চেমায়ুং-দুং নামক হিমবাহ (৩১°৩০´ উত্তর এবং ৮০°২০´ পূ) থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। সুবিশাল বঙ্গীয় সমভূমিতে পতিত হওয়ার পূর্বে আসামে ব্রহ্মপুত্র নদ ডিহাং নামে অভিহিত। কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা নদীর সঙ্গে সঙ্গমের পূর্ব পর্যন্ত সাংপো-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৭০০ কিমি। বাংলাদেশ ভূখন্ডে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার দৈর্ঘ্য ২৭৬ কিমি যার মধ্যে যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য ২০৫ কিমি।

নদীটির প্রশস্ততা ৩ কিমি থেকে ২০ কিমি পর্যন্ত, তবে এর গড় প্রশস্ততা প্রায় ১০ কিমি। বর্ষা ঋতুতে যমুনার প্রশস্ততা কোন স্থানেই ৫ কিমি-এর কম হয় না। বাস্তবে যমুনা একটি চরোৎপাদী নদী। কয়েকশত মিটার থেকে কয়েক কিমি প্রশস্ততা বিশিষ্ট বিভিন্ন আকৃতির, এবং বিনুনি, সর্পিলাকৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন প্যাটার্নের প্রবাহখাত নিয়ে যমুনা নদী গঠিত। বাংলাদেশে অবস্থিত যমুনার প্রবাহপথের অধিকাংশ স্থানেই অসংখ্য চর গড়ে উঠেছে যেগুলো বর্ষা ঋতুতে ডুবে যাওয়ার ফলে নদীটি একটি একক খাতে পরিণত হয়। এভাবে শুধুমাত্র প্রশস্ততার কারণে নদীটি বিশ্বের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীতে পরিণত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পৃথক পৃথক প্রবাহখাতগুলির প্রস্থ ও গভীরতার অনুপাত ৫০:১ থেকে ৫০০:১ পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে নদীটির নতিমাত্রা ০.০০০০৭৭, যা গঙ্গার সঙ্গে মিলনস্থানের নিকটবর্তী এলাকায় ০.০০০০৫-এ  হ্রাস পায়।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী অববাহিকার আয়তন প্রায় ৫,৮৩,০০০ বর্গ কিমি যার মধ্যে ২,৯৩,০০০ বর্গ কিমি তিববতে, ২,৪১,০০০ বর্গ কিমি ভারতে এবং শুধুমাত্র ৪৭,০০০ বর্গ কিমি বাংলাদেশে অবস্থিত। বাহাদুরাবাদের উজানে ব্রহ্মপুত্র ৫,৩৬,০০০ বর্গ কিমি এলাকা নিষ্কাশিত করে থাকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালী দেশে উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত সর্বাধিক প্রশস্ত নদীপ্রণালী। বাহাদুরাবাদে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের প্রবাহ রেকর্ড করা হয়ে থাকে। পরিমাপকৃত প্রবাহে বাংলাদেশে প্রবেশকৃত দুধকুমার, ধরলা এবং তিস্তা নদীর প্রবাহ যোগ করা হয় এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও বাঙ্গালী নদীর প্রবাহ বিয়োগ করা হয়ে থাকে। বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদীর প্রবাহ থাকে বিশাল পরিমাণের এবং গড়ে প্রায় ৪০,০০০ কিউমেক। এই পরিমাণ প্রবাহের দ্বারা নদীটি আমাজন, কঙ্গো, লা প্লাটা, ইয়াংসি, মিসিসিপি এবং মেঘনার পরেই সপ্তম বৃহত্তম স্থানে অবস্থান করে নিয়েছে। ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে যমুনায় রেকর্ড পরিমাণ প্রবাহ পরিমাপ করা হয় যার পরিমাণ ছিল ৯৮,৬০০ কিউমেক। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার বার্ষিক গড় প্রবাহ প্রায় ৫০১ মিলিয়ন একর-ফুট।

আগস্ট মাসে প্রায়ই ব্যাপক বিস্তৃত বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। মে মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সংঘটিত বন্যা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা নদীতে প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। গঙ্গার তুলনায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর প্রবাহ অধিকতর গতিসম্পন্ন। যমুনার গড় নতিমাত্রা ১:১১,৮৫০, গঙ্গার নতিমাত্রার তুলনায় সামান্য বেশি। বিশাল আয়তনের জলরাশি প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে যমুনা প্রচুর পরিমাণে পলিরাশিও বহন করে থাকে। বর্ষা ঋতুতে যমুনা নদী দৈনিক প্রায় ১২ লক্ষ টন পলি বহন করে আনে এবং বাহাদুরাবাদে পরিমাপকৃত যমুনার বার্ষিক পলিবহন ক্ষমতা প্রায় ৭৩৫ মিলিয়ন টন।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনার চারটি প্রধান উপনদী রয়েছে: দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া-আত্রাই নদীপ্রণালী। এদের মধ্যে দুধকুমার, ধরলা এবং তিস্তা নদী তিনটি খরস্রোতা প্রকৃতির এবং ভারতের দার্জিলিং ও ভূটানের মধ্যবর্তী হিমালয়ের দক্ষিণপার্শ্বে অত্যধিক ঢালবিশিষ্ট অববাহিকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। শাখানদীসমূহের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দীর্ঘতম এবং দুইশত বছর পূর্বে এটিই ছিল ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিধারা।

যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে যমুনা নদীর উপর সাম্প্রতিক কালে ৪.৮ কিমি দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু নামে অভিহিত এই সেতুর পূর্ব প্রান্ত টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর উপজেলায় এবং পশ্চিম প্রান্ত সিরাজগঞ্জ জেলার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত। সেতুতে বিদ্যমান সড়ক ও রেলপথে যাত্রী ও পণ্যের দ্রুত পরিবহণ ছাড়াও সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চালন এবং টেলিযোগাযোগ ত্বরান্বিত হয়েছে। সেতুটি ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অত্যধিক প্রচরণশীল যমুনা নদীকে সেতু দ্বারা নির্ধারিত খাতে প্রবাহমান রাখার জন্য ব্যাপক নদীশাসন কর্মকান্ড সম্পন্ন করা হয়।

প্রকৃতিগতভাবে যমুনা নদীটি বিনুনি অথবা চরোৎপাদী প্রকৃতির। এর বিনুনি বলয়ের মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য চর বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৯২ সালের শুষ্ক ঋতুতে তোলা ল্যান্ডস্যাট ইমেজ (Landsat image) থেকে দেখা যায় যমুনা নদীতে ৫৬টি বৃহদাকৃতির দ্বীপ বা চর বিদ্যমান রয়েছে যাদের প্রতিটি ৩.৫ কিমি-এর অধিক দীর্ঘ। বালুময় চর এবং উদ্ভিদ আচ্ছাদিত চরও এই হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মুখের বিপরীত প্রবাহে, সিরাজগঞ্জের উত্তর ও পূর্ব পার্শ্বে এবং গঙ্গার সঙ্গে মিলনস্থলের উজানে যমুনার দক্ষিণতম প্রবাহে নিয়মিত চর গঠন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়েছে। বিভিন্ন নদীর তীর ভাঙনের কবলে পড়ে ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায় ৭,২৯,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল যমুনার তীর ভাঙনের শিকার।  [মাসুদ হাসান চৌধুরী]

আরও দেখুন ব্রহ্মপুত্র নদ; ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালী

মানচিত্রের জন্য দেখুন ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপ্রণালী