ম্যলেন্স হানা, ক্যাথরিনা

ম্যলেন্স হানা, ক্যাথরিনা (১৮২৬-১৮৬১)  খ্রিস্টধর্ম প্রচারক, বাংলা গদ্য লেখক, নারীশিক্ষা প্রচারক। তাঁর প্রকৃত নাম হানা ক্যাথরিন লাক্রোয়া। তিনি ১৮২৬ সালের ১ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রেভারেন্ড ফ্রাঁসোয়া লাক্রোয়া ছিলেন একজন ফরাসি।

১৮২১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে লাক্রোয়া লন্ডন মিশনারি সোসাইটির কর্মী হিসেবে কলকাতায় আসেন। হানা ক্যাথরিনের বাল্যকালে কলকাতায় মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার কোনো স্কুল বা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ফলে তাঁকে গৃহেই মায়ের কাছে লেখাপড়া শিখতে হয়েছিল। তিনি বাড়ির বাঙালি ভৃত্যদের কাছ থেকে চলতি বাংলায় কথা বলা শিখেন। ভবানীপুরে মিশনারিদের নতুন কেন্দ্র খোলার পর বাঙালি মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। হানা ক্যাথরিন উক্ত স্কুলে প্রত্যহ বাংলায় একটি ক্লাস নিতেন। এমনকি বাড়িতেও মহিলা ভৃত্য ও তাদের সন্তানদের তিনি লেখাপড়া শেখাতেন। ব্যবস্থাটি পরে নিয়মিত স্কুলে পরিণত হয়। ১৮৪১ সালে পিতামাতার সঙ্গে তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখানে তিনি মিসেস র‌্যামজে নামক এক ভদ্রমহিলার তত্ত্বাবধানে আঠারো মাস শিক্ষালাভ করেন।

১৮৪৫ সালের ১৯ জুন মিশনের কর্মী মি জে. ম্যলেন্সের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তাঁর নামের শেষে ম্যলেন্স সংযুক্ত হয়। এসময় তিনি মেয়েদের স্কুল পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। মিশন স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হয়েও তিনি বাঙালি মেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতি ও প্রথায় জীবনযাপনে উৎসাহ দিতেন। ১৮৫৫ সালে প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে কলকাতায় জেনানা মিশন স্থাপিত হয়। এ মিশনের কাজ ছিল কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবারের অন্দরমহলে গিয়ে মেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। কিছুদিনের জন্য স্বামীর সঙ্গে তাঁকে ১৮৫৮ সালে ইংল্যান্ডে চলে যেতে হয়। ১৮৬১ সালে তিনি প্রত্যাবর্তন করে কলকাতার নারীশিক্ষার কেন্দ্রগুলির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর লেখিকা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁর পিতা তাঁকে সাহিত্যচর্চা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের কারণে পিতার মৃত্যুর পর তিনি নতুন গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলা ভাষার চর্চা করে গেছেন।

১৮৫২ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ফুলমণি ও করুণার বিবরণ কলকাতার খ্রিস্টান ট্র্যাক্ট অ্যান্ড বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। খ্রিস্টধর্মান্তরিত অল্পশিক্ষিত হিন্দু বাঙালি পরিবারের ঘটনাবলী নিয়ে বাংলা সহজ গদ্যে বইটি রচিত হয়। এর ভাষা, চরিত্র চিত্রণ, বিষয়বস্ত্ত ও পরিবেশ সৃজনে উপন্যাসের ছাপ রয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণ ও বাংলা গদ্যের বিকাশে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) গ্রন্থের ছয় বছর পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থটির অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে এটি ১২টি ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষায় অনুদিত হয়। এ ছাড়া তিনি ১৮৫১ ও ১৮৫৬ সালে Voyages and Travels of a Bible ও Day Break in Britain বই দুটির বাংলা অনুবাদ করেন। তাঁর আরেকটি বই, বিশ্বাস বিজয় অর্থাৎ বঙ্গদেশে খ্রিস্টধর্মের গতির রীতি প্রকাশার্থ উপাখ্যান। বইটির ৭ম অধ্যায় পর্যন্ত তাঁর রচনা, বাকি অধ্যায়গুলি পরিবারের অন্য সদস্যরা সমাপ্ত করেন। ১৮৬১ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।  [মোবার্রা সিদ্দিকা]