মেজবান

মেজবান  চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। মেজবান ফার্সী শব্দ। অতিথি আপ্যায়নকারী মেজবান আর মেজবানি হচ্ছে আতিথেয়তা, মেহমানদারি অথবা অতিথিদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা। কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আয়োজিত একটি গণভোজ। প্রিয়জনদের মৃত্যু বা মৃত্যু দিবস, জন্ম বা জন্মদিবস, নিজেদের কোনো সাফল্য, নতুন কোনো ব্যবসা শুরু, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, পরিবারে আকাঙ্ক্ষিত শিশুর জন্ম, বিবাহ, আকিকা ও সুন্নতে খৎনা, মেয়েদের কান ছেদন এবং নবজাতকের নাম রাখা উপলক্ষে মেজবানির আয়োজন করা হয়। মেজবানির দাওয়াত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। গ্রামাঞ্চলে কোনো ধণাঢ্য ব্যক্তি মেজবানির আয়োজন করলে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে সেই ভোজের দাওয়াত বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় পৌঁছে দেয়া হয়। কেবল শহরাঞ্চলেই দাওয়াতকার্ড ছাপিয়ে অতিথিদের মাঝে বিলি করা হয়।

মেজবানকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় মেজ্জান। চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী অঞ্চলে মেজবানি ‘জেয়াফত’ নামে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও বিভিন্ন উপলক্ষে ভোজের আয়োজন হয়। তবে মেজবানি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই অধিক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত ভোজ। এই অঞ্চলে আগে মেজবানির দাওয়াত হাটেবাজারে ঢোল পিটিয়ে বা টিনের চুঙ্গি ফুঁকিয়ে প্রচার করা হতো আর সে খবর লোকমুখে পাড়া-মহল্লার ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতো এবং নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে হাজির হয়ে ছেলে বুড়ো সবাই মেজবানির খাবার খেতো। আজও চট্টগ্রামের ধণাঢ্য ব্যক্তিরা সাধ্যমত ঘরে ঘরে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে মেজবানির দাওয়াত পৌঁছান। এ ঐতিহ্য চট্টগ্রামের অতি প্রাচীনকালের।

মেজবান ও মেজবানি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপলক্ষে ধনী-গরীব সাধ্যমতো ভোজের আয়োজন করে থাকে। সাদা ভাতের সঙ্গে তিন বা চার ধরণের তরকারি পরিবেশিত হয় যেমন গরুর মাংস, নলা কাঁজি ও কলই বা বুটের ডাল। এর রন্ধন প্রণালী বৈশিষ্টপূর্ণ, যেমন (ক) মরিচ ও মসলা সহযোগে রান্না করা ঝাল গোসত; (খ) গরুর নলা দিয়ে কম ঝাল, মসলাটক সহযোগে রান্না করা শুরুয়া বা কাঁজি, যা নলা কাঁজি নামে পরিচিত; (গ) মাসকলাই ভেজে খোসা ছাড়িয়ে ঢেঁকিতে বা মেশিনে গুড়ো করে এক ধরনের ডাল রান্না করা হয়। এটাকে ‘ঘুনা ডাল’ বলে; (ঘ) কলইর ডালের পরিবর্তে বুটের ডালের সাথে হাঁড়, চর্বি ও মাংস দিয়ে হালকা ঝালযুক্ত খাবার তৈরি করা হয়।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ করে ছাগল দিয়ে নবজাতকের খৎনা বা আকিকা উপলক্ষে মেজবানি দেয়া হয়। মাছের মেজবানিও হয়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ত্রিপুরা, চাকলা রওশনাবাদ ও চট্টগ্রামের (ইসলামাবাদ) উত্তরাঞ্চলের জমিদার শমসের গাজী তাঁর মা কৈয়ারা বেগমের নামে দীঘি খনন শেষে আশপাশের দীঘি ও চট্টগ্রামের নিজামপুর অঞ্চলের দীঘিপুষ্করিণী থেকে মাছ ধরে এনে বিশাল ভোজ দেন। চট্টগ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় সেকালে গরুর পরিবর্তে মাছের মেজবান দেয়া হতো। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় চট্টগ্রাম পরিষদের ব্যানারে মাছ, সবজি ও শুটকির তরকারি রান্না করে প্রতিবছর মেজবানি আয়োজন করে।

রাজধানী ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরু হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকার সভাপতি (১৯৬৮-৮৩) থাকাকালে। তাঁর অনুরোধে তেজগাঁওস্থ বাবলী ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক প্রয়াত মোজাম্মেল হক একক আয়োজনে মেজবানির প্রচলন করেন যা পরবর্তীতেকালে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের ক্ষুদ্র গন্ডি ছাড়িয়ে ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে প্রায় অর্ধলক্ষ লোকের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া মেজবানি সিলেট, খুলনা এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগ ছাড়া সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও মেজবানির আয়োজন হয়। মেজবানকে ঘিরে চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকেরা রচনা করেছেন অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ। যেমন:

কালামন্যা ধলামন্যা

আনের আদা জিরা ধন্যা

আর ন লাগে ইলিশ-ঘন্যা

গরু-খাসি বুটর ডাইলর

বস্তা দেখা যায়-

মেজবানি খাতি আয়...

সাধারণত সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একনাগাড়ে মেজবানি খাওয়ানো হয়। আগের দিন রাতে আয়োজকের বিশেষ আমন্ত্রণে আসা লোকজন, মেজবানির কর্মী এবং পাড়াপ্রতিবেশীরা একসাথে বসে সলাপরামর্শ শেষে খানা খান। যাকে চট্টগ্রামী মুসলমানরা ‘আগদাওয়াত’ বা ‘আগ দাওতি’ বলে। মূলত পরদিনের মেজবানি উপলক্ষে এ ‘আগ দাওতি’ অনুষ্ঠান। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা এই অনুষ্ঠানকে ‘পান সলাৎ’ বলে।

মেজবানি উপলক্ষে, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী, এমনকি তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও অন্য জেলার লোকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাধারণত কেউ মেজবানি খানা থেকে নিজেদের বিরত রাখেন না। চট্টগ্রামী মেজবানি রান্নার বাবুর্চি ও তাদের সহকর্মী সকলেই চট্টগ্রামের লোক এমনকি চট্টগ্রামের বিশেষ অঞ্চলে উৎপাদিত বিশেষ স্বাদযুক্ত মরিচ-হলুদ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। [আহমদ মমতাজ]