মৃত্তিকার অম্লত্ব

মৃত্তিকার অম্লত্ব (Soil Acidity)  মৃত্তিকার অম্লীয় গুণ বা অবস্থা। এ গুণ এসিডীকরণের ফলে সৃষ্টি হয়। এসিডীকরণ হলো কোন ইকোসিস্টেমে হাইড্রোজেন আয়ন উৎপত্তির একটি প্রক্রিয়া। ইকোসিস্টেমের উপাদান হিসেবে মৃত্তিকা অম্লত্ব মৃত্তিকার উৎসবস্ত্ত এবং মৃত্তিকা সৃষ্টির পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। মৃত্তিকা এসিডীকরণ একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা শিলাপৃষ্ঠের উপর প্রথম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শৈবাল ও লাইকেনের ক্রিয়াকলাপ দ্বারা শুরু হয়। কার্বন ও নাইট্রোজেন চক্র থেকে জাত এসিডগুলো প্রধানত মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা ও শিলা মণিককে দ্রবীভূত করে। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমে মৃত্তিকাগুলো ধীরে ধীরে অধিক অম্লগুণ সম্পন্ন হয়, যা নতুন মৃত্তিকার তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত ইকোসিস্টেমের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যকলাপের ফলে মৃত্তিকা এসিডীকরণের হার দ্রুততর হয়। হাইড্রোজেন ও অ্যালুমিনিয়াম- এ দুটি পরিশোষিত আয়নের উপস্থিতি মৃত্তিকার অম্লত্বের জন্য প্রধানত দায়ী। হাইড্রোজেন আয়ন ইকোসিস্টেমে যোগ হতে বা অপসারিত হতে পারে, বা এ আয়ন ইকোসিস্টেমের মধ্যে সংঘটিত বিক্রিয়ায় উৎপন্ন বা অপচয়িত হতে পারে।

মৃত্তিকার এসিডীকরণ ক্যালসিয়াম কার্বনেট (চুন) প্রয়োগ করে হ্রাস বা সালফিউরিক এসিড যোগ করে বৃদ্ধি করা যায়। আর্দ্র অঞ্চলে অম্ল মৃত্তিকা পাওয়া যায়, কারণ এসব এলাকায় ক্ষারকীয় ধনাত্মক আয়নগুলো নিচের দিকে ক্ষালিত হয়। মৃত্তিকাতে এসিড উৎপন্নকারী সারের রূপান্তর থেকে মৃত্তিকার এসিডীকরণ হতে পারে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের ফলে প্রথম দিকে পি এইচ সামান্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু রূপান্তরের পরবর্তী ধাপে ইউরিয়ার পানি বিয়োজন থেকে উৎপন্ন অ্যামোনিয়াম জারিত হয়ে নাইট্রেট উৎপন্ন করে এবং একই সঙ্গে উৎপন্ন হাইড্রোজেন আয়ন মৃত্তিকার এসিডীকরণে প্রভাব রাখে।

এসিডীকরণের প্রভাব পি.এইচ মান দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এসিডীকরণের মাত্রার উপর ভিত্তি করে মৃত্তিকাকে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়। পি.এইচ মানের উপর ভিত্তি করে মৃত্তিকার শ্রেণীবিন্যাসটি হলো: (ক) অত্যন্ত প্রবল অম্লীয় (পি.এইচ মান ৪.৫), (খ) প্রবল অম্লীয় (পি.এইচ মানের পরিসর ৪.৫ থেকে ৫.৫), (গ) মধ্যম অম্লীয় (পি.এইচ মানের পরিসর ৫.৬ থেকে ৭.৩)।

গাছের পুষ্টি উপাদানের লভ্যতা, ধাতুর বিষাক্ততা এবং মৃত্তিকা কলয়েডের ক্ষারক সম্পৃক্তির শতকরা হারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক ধর্মাবলির উপর মৃত্তিকা এসিডীকরণের বিশেষ প্রভাব আছে। মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলির মধ্যে মৃত্তিকার সংযুতি সৃষ্টি এবং এর ফলে মৃত্তিকার পানি-বায়ু সম্পর্ক মৃত্তিকার এসিডীকরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন প্রকার অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থ ও অন্যান্য মৃত্তিকা উপাদানের রূপান্তরও মৃত্তিকা এসিডীকরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের কৃষি জমিতে চাষাবাদের ফলে মৃত্তিকা এসিডীকরণের তীব্রতা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ক্যালকেরিয়াস মৃত্তিকাতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের অধিকাংশ পলল অবক্ষিপ্ত হওয়ার শুরুতে প্রায় নিরপেক্ষ থেকে মধ্যম ক্ষারীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন। তৎসত্ত্বেও চুনহীন অবক্ষেপের উপর পললের সঞ্চয়ন বন্ধ হয়ে গেলে এসব মৃত্তিকা প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে মধ্যম অম্ল বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যায় এবং চুণযুক্ত পললের পৃষ্ঠমৃত্তিকা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে চুনহীন (decalcified) হয়ে পড়ে। এসব মৃত্তিকার বিক্রিয়া অম্লীয় হয়ে যেতে পারে। গাঙ্গেয় ও গাঙ্গেয় নয় এমন পললে সৃষ্ট কিছুটা পুরাতন পললভূমিতে পৃষ্ঠমৃত্তিকার পি.এইচ মান সাধারণত ৪.৫ থেকে ৫.৫। এই পি.এইচ মান কেবল শুষ্ক ঋতুতে পাওয়া যায়। মৌসুমমাফিক প্লাবিত মৃত্তিকার ক্ষেত্রে কেবল পৃষ্ঠমৃত্তিকা অম্লীয় হয় এবং অন্তঃমৃত্তিকার স্তরগুলোর বিক্রিয়া নিরপেক্ষ থেকে ক্ষারীয় থেকে যায়। এসিড অববাহিকা এঁটেলে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার বা পৃষ্ঠ থেকে আরও অধিক গভীরতা পর্যন্ত অন্তঃমৃত্তিকা অত্যন্ত প্রবল অম্লীয় (পি.এইচ ৫.০)। এমনকি অববাহিকা কেন্দ্রে অবস্থিত চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রবল থেকে অত্যন্ত প্রবল অম্লীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং আরও অধিক গভীরতায় এসব মৃত্তিকা কেবল চুনযুক্ত হয়। [আমিনুল ইসলাম এবং সিরাজুল হক]