মুর্শিদকুলী খান, দ্বিতীয়

মুর্শিদকুলী খান, দ্বিতীয়  নওয়াব সুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান এর জামাতা। তিনি প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) ও পরে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম ছিলেন। তিনি রুস্তম জঙ্গ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন কবি এবং হস্তলিপিবিদ্যার প্রতি অনুরাগী। কবি হিসেবে তাঁর নাম ছিল  ‘মাখমুর’।

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মুর্শিদকুলী খান যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা মীর হাবিবের সহযোগিতা পেয়েছিলেন যিনি রাষ্ট্রীয় নৌবাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী ও সামরিক ব্যবস্থাপনায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন। ব্যবসায়ীদের কিছু পণ্যের উপর একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার প্রদান করে এবং অবাধ্য জমিদারদের সম্পদ দখল করে তিনি প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হন। মীর হাবিব প্রতাপসরের  জমিদার আগা সাদেকের সঙ্গে মিলে ত্রিপুরারাজ্যে অতর্কিত আক্রমণ চালান। এই অভিযানে ত্রিপুরারাজের অসন্তুষ্ট ও বিতাড়িত ভ্রাতুষ্পুত্র  আক্রমণকারীদের সাহায্য করেন। অতর্কিত আক্রমণে বিভ্রান্ত হয়ে রাজা পালিয়ে গেলে রাজ্যটি মীর হাবিবের অধিকারভুক্ত হয়। রাজার ভ্রাতুষ্পুত্রকে  সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। আগা সাদেককে ত্রিপুরার ফৌজদার নিয়োগ করে মীর হাবিব যুদ্ধলব্ধ অঢেল সম্পদ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর ফিরে আসেন। নওয়াবকে এই  বিজয় সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং  ত্রিপুরার নতুন নামকরণ হয় রওশনাবাদ।

সরফরাজ খান এর বৈমাত্রেয় ভাই তকী খানের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খানকে জাহাঙ্গীরনগর থেকে উড়িষ্যায় বদলি করা হয়। আলীবর্দী খান (১৬৭৬-১৭৫৬) এর বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী সরফরাজ খানকে কার্যত সাহায্য করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খানের পরাজয়ের পর আলীবর্দী বাংলা ও বিহারের অধিপতি হন। কিন্তু তখনও উড়িষ্যা পদানত হয়নি। রুস্তম জঙ্গ আলীবর্দীর প্রভুত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন। বাংলার সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে তিনি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে কটক থেকে বালেশ্বর অভিমুখে অগ্রসর হন। তার মোকাবেলার জন্য আলীবর্দী খানও রাজধানী থেকে সসৈন্যে অগ্রসর হন। যাত্রাপথে মেদিনীপুরের জমিদারগণ তাঁকে সমর্থন করলেও উড়িষ্যার অপরাপর অনেক জমিদার তাঁর প্রতি শক্রভাবাপন্ন ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আলীবর্দী বিরোধিতা পরিহারের চিন্তা করেন। কিন্তু সামরিক সংঘর্ষ  অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় মুর্শিদকুলীর জামাতা মির্জা বকর প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত এবং ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে ফুলওয়ারীতে মারাত্মকভাবে আহত হন। রুস্তম জঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন এবং তাঁর আহত জামাতাকে নিয়ে মসুলিপত্তমে পালিয়ে যান। রুস্তম জঙ্গের এক বন্ধু ও খুর্দার জমিদার আলীবর্দীর সৈন্যদের কবল থেকে মির্জা বকরের পরিবারকে রক্ষা করেন।

আলীবর্দী খান এক মাস উড়িষ্যায় অবস্থান করেন। তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা সৈয়দ আহমদ খান সওলত জঙ্গকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম নিয়োগ করে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।

মির্জা বকর অচিরেই সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং মারাঠাদের সাহায্য নিয়ে সৈয়দ আহমদের অনভিজ্ঞ সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান। এটি ছিল সৈয়দ আহমদের জন্য একটি শোচনীয় পরাজয়। তিনি তাঁর পরিবার-পরিজন সহ শত্রুর হাতে বন্দি হন এবং তাদের কড়া পাহারায় রাখা হয়। মেদিনীপুর ও হিজলিও বাংলার নওয়াবের হস্তচ্যুত হয়।

এই বিপর্যয় ছিল উড়িষ্যায় আলীবর্দী খানের নব প্রতিষ্ঠিত আধিপত্যের প্রতি একটি বড় আঘাত এবং এতে তাঁর মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয়। জামাতা ও তাঁর পরিবারবর্গকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আলীবর্দী খান মির্জা বকরের নিকট থেকে উড়িষ্যা পুনরুদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেন। এবারও ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মির্জা বকর পরাজিত হন। মির্জা বকর পুনরায় দাক্ষিণাত্যে মারাঠা মিত্রদের নিকট আশ্রয় নেন। সৈয়দ আহমদ ও তাঁর পরিবারবর্গকে উদ্ধার করে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়। আলীবর্দী খান তিন মাস উড়িষ্যায় অবস্থান করেন এবং তাঁর বন্ধু শেখ মাসুমকে উড়িষ্যার নায়েব নাজিম নিয়োগ করে মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। অবশ্য এ ঘটনার পরও আলীবর্দীর আধিপত্য নিরঙ্কুশ হয়নি। কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতি বছরই মারাঠারা আলীবর্দীর রাজ্যে আক্রমণ অব্যাহত রাখে।

আলীবর্দী খানের নিকট পরাজয়ের পর দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খান সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না। তাঁর সুযোগ্য কর্মচারী মীর হাবিব ও জামাতা মির্জা বকর যখন হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন, তখন সম্ভবত দাক্ষিণাত্যে অজ্ঞাতবাসে তাঁর মৃত্যু হয়।  [কে.এম করিম]