মুজিব বাহিনী

মুজিব বাহিনী  মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী।  আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এর নেতৃত্বে ছিল ১৯-সদস্যের কেন্দ্রীয় কম্যান্ড। প্রথমদিকে সেক্টর কম্যান্ডারগণ ভারতের ব্যারাকপুর, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও মেঘালয় থেকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করতেন। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কম্যান্ডার ছিলেন তোফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও  শেখ ফজলুল হক মনি। শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

মুজিব বাহিনীর গঠন এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পর্কে  মুজিবনগর সরকার অবহিত ছিল না। এ বাহিনী মুজিবনগর সরকারের প্রতি কোন আনুষ্ঠানিক আনুগত্যও প্রকাশ করেনি। ফলে মুজিব বাহিনী গঠনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের ভেতরে ও বাইরে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। এ মতপার্থক্য নিরসনকল্পে ডি.পি ধর ও জেনারেল মানেক শ’র ন্যায় ভারতের কতিপয় ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এবং মুজিব বাহিনীর নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতায় মধ্যস্থতা করেন। ভারত সরকার এ বাহিনীকে একটি সি-৪, একটি এন-১২ এবং একটি পুরাতন ডাকোটা বিমান সহ বেশ কিছু ট্রাক ও জীপ প্রদান করে।

কারো কারো ধারণা মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজন মোকাবেলার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। আবার অন্যদের মতে, মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট ছিল না বলে এবং আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশের কার্যক্রমে সন্ধিহান থাকায় সংগঠকরা মুজিব বাহিনী গঠন করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মুজিব বাহিনী যুদ্ধ করেছে। তারা দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন এবং ঢাকার আশে পাশে বেশ কিছু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। মুজিব বাহিনীর সদস্যগণ গেরিলা রণকৌশলে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।

বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ধারণার উন্মেষ ঘটে বলে ধারণা করা হয়। সেসময় কতিপয় জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এটি একটি একাডেমিক চিন্তা হিসেবে লালিত হত। মুজিব বাহিনীর অগ্রণী সংগঠকরাই একসময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং তাঁরাই ছিলেন ১৯৬৯ সালের এগারো দফা কর্মসূচির প্রবক্তা। তাঁরা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করেন, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের পথে সার্বিক প্রস্ত্ততি সংগঠিত করেন।  [হেলাল উদ্দিন আহমেদ]