মুজিবনগর

মুজিবনগর  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতর বা প্রশাসনিক কেন্দ্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার মুক্তাঞ্চলে সরকারের শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় হওয়া সত্ত্বেও আকাশবাণীসহ আরও দু’একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এ তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণের স্থান নির্ধারিত হয়। বৈদ্যনাথতলার ভৌগোলিক অবস্থান এমন সুবিধাজনক ছিল যে, পাকবাহিনী কর্তৃক এখানে স্থল বা আকাশ পথে আক্রমণ করা যেমন কষ্টসাধ্য ছিল তেমনি আক্রমণের আভাষ পাওয়া গেলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়াও সহজ ছিল। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ভারতীয় বিএসএফ-এর মাধ্যমে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটিকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। স্থানীয় জনতা, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গার বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ভারতীয় বিএসএফ শপথ গ্রহণের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দেশি ও বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিত করার দায়িত্ব বর্তায় আবদুল মান্নান এমএনএ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের ওপর। তাঁরা ১৬ এপ্রিল কলকাতা প্রেসক্লাবে উপস্থিত হয়ে জানান যে, ১৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করা হবে। ১৭ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে আওয়ামী লীগের এমএনএ, এমপিএ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে বৈদ্যনাথতলার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। অতি প্রত্যুষে সাংবাদিকদের গাড়িবহর যাত্রা শুরু করে। বেলা ১১ টার দিকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীবর্গ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ। অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। পুলিশের ডিএসপি মাহবুব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন স্থানীয় শাহাবউদ্দিন আহমদ সেন্টু, পিন্টু বিশ্বাস, মনসুর উদ্দিন মোল্লা ও আসাদুল হক প্রমুখ। পবিত্র কোরান, বাইবেল ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ করেন যথাক্রমে বাকের আলী, পিন্টু বিশ্বাস ও ননী গোপাল ভট্টাচার্য। স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির দোয়াজ আলী মাস্টার ও আইয়ুব হোসেনের নেতৃত্বে পার্শ্ববর্তী এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ ‘জয়বাংলা বাংলার জয়, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগান দেয়। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এতে বিশ্ববাসীকে, বিশেষভাবে বৃহৎশক্তিবর্গকে বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়।  [মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান]