মিত্র, প্রেমেন্দ্র

মিত্র, প্রেমেন্দ্র (১৯০৪-১৯৮৮)  কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক। জন্ম ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাশিতে। পৈতৃক নিবাস দক্ষিণ চবিবশ পরগণার বৈকুণ্ঠপুরে। পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র ভারতীয় রেলওয়াতে চাকরি করতেন। মাতার নাম সুহাসিনী দেবী।

প্রেমেন্দ্র মিত্র কলকাতার সাউথ সাবার্বন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯২০) পাস করে সাহিত্য-সাধনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ১৯২৩ সালে প্রবাসীতে ‘শুধু কেরাণী’ ও ‘গোপন চারিণী’ নামে দুটি গল্প প্রকাশিত হয় এবং গল্প দুটি নিয়ে কল্লোল পত্রিকা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করে। ফলে সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর খ্যাতি বেড়ে যায়। সাহিত্য-সাধনার প্রথমপর্বে তিনি ‘কৃত্তিবাস ভদ্র’ ছদ্মনামে লিখতেন।

প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্লোল (১৯২৩) পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। পরে মুরলীধর বসুর সহযোগিতায় কালিকলম (১৯২৬) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে নিজের লেখায় সাঙ্গীকরণের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক মতবাদকে সমীহ করলেও সেসব তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করেননি। সেসব মতবাদ তিনি গ্রহণ করেছেন স্বদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, গরিব ও শ্রমজীবী সমাজের প্রতি সহমর্মিতার মাধ্যমে। তিনি একটি কবিতায় বলেন: ‘আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের, মুটে মজুরের,/ আমি কবি যত ইতরের!’ রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যজগতে যে ধারার সূচনা করেছিলেন প্রথম জীবনে তার দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরে তিনি তাঁর নিজের স্বতন্ত্র পথ খুঁজে পান।

তাঁর রচিত উপন্যাসে বাস্তবতার রূপায়ণ আছে। মৃদু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পরিবেশন এবং কপটতার বিরুদ্ধে কষাঘাত তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য। এ কারণে তাঁর গল্প প্রথাগতভাবে কল্লোল-এর গল্প থেকে স্বতন্ত্র। সহযাত্রীদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক অন্তর্গূঢ় ও বলিষ্ঠ লেখক। নগর জীবনের ধোঁয়াশা, অব্যাহত ব্যর্থতা, অভিমানের পরাভব, জীবনের বিশেষ অনিবার্যতাকে তিনি অনুভব করেছিলেন এবং তা গল্পে রূপদান করে গেছেন। নিজের পেশার বৈচিত্র্যের মতো তাঁর লেখাতেও বৈচিত্র্য ছিল।

কবিতা, উপন্যাস, গল্প ছাড়াও তিনি সৃজনশীল প্রবন্ধ, গান, চিত্রনাট্য, রম্যরচনা এবং গোয়েন্দা কাহিনিও লিখেছেন। হাস্যকৌতুকের ধারায় তাঁর অমর সৃষ্টি ‘পরাশর বর্ম’। বাংলা শিশুসাহিত্যে তাঁর অতুলনীয় সৃষ্টি ‘ঘনাদা’। শিশুর মনোরাজ্যের রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলি তিনি ঘনাদা চরিত্রের মাধ্যমে অভিব্যক্ত করেন। ঘনাদা পড়ে প্রতিটি শিশু-কিশোর ঘনাদার ভিতর দিয়ে নিজেদের দেখতে উন্মুখ হয়ে ওঠে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের এ ঘনাদা সৃষ্টি হয় প্রথম ‘মশা’ (১৯৩৭) গল্পের মাধ্যমে। কিশোর মনোরাজ্য অধিকারের জন্য ডিটেকটিভ ও রোমাঞ্চকর কাহিনি সৃজনে তিনি অসাধারণ শক্তির পরিচয় দেন। অপরদিকে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক কিশোর উপন্যাস কুহকের দেশে লিখে বাংলা ভাষায় এ ধারার সার্থকতা প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রেমেন্দ্র মিত্র সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে যৌথভাবে রচনা করেন বিসর্পিল ও বনশ্রী নামে দুটি উপন্যাস। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও বুদ্ধদেব বসু তাঁর এ সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উপন্যাস দুটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে।

তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য: প্রথমা (১৯৩২), সম্রাট (১৯৪০), সাগর থেকে ফেরা (১৯৫৬), ফেরারী ফৌজ (১৯৫৮), হরিণ চিতা চিল (১৯৫৯), কখনো মেঘ (১৯৬১), অথবা কিন্নর (১৯৬৫),  নদীর নিকটে (১৯৭২); গল্পগ্রন্থ : পঞ্চশর (১৯২৯), বেনামী বন্দর (১৯৩০), পুতুল ও প্রতিমা (১৯৩২), মৃত্তিকা (১৯৩২), অফুরন্ত (১৯৩৫), মহানগর (১৯৩৭), ধূলিধূসর (১৯৩৮), নিশীথ নগরী (১৯৩৮), কুড়িয়ে ছড়িয়ে (১৯৪৬), সামনে চড়াই (১৯৪৭), প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৫২), সপ্তপদী (১৯৫৫), জল পায়রা (১৯৫৭), নানা রঙে বোনা (১৯৬০);  উপন্যাস : পাঁক (১৯২৬), কুয়াশা (১৯৩০), মিছিল (১৯৩৩), উপনয়ন (১৯৩৩), আগামীকাল (১৯৩৪), প্রতিশোধ (১৯৪১), প্রতিধ্বনি ফেরে (১৯৬১), অন্য এক নাম (১৯৬২), পা বাড়ালেই রাস্তা (১৯৬২), পতাকা যারে দাও (১৯৬৩), স্তব্ধ প্রহর (১৯৬৩), মনুদ্বাদশ (১৯৬৪), অমলতাস (১৯৬৫), স্বপ্নতনু (১৯৬৫), দিগ্বলয় (১৯৬৭), যিনি বিধাতা (১৯৭০), সেই যে শহর রাজোলি (১৯৭২)।

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র শরৎ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫৪), আকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৬), আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), নেহেরু পুরস্কার (১৯৭৬) পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া শিশু সাহিত্য পরিষদের ভুবনেশ্বরী পদক (১৩৭৮), দেশিকোত্তম উপাধি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের হরনাথ ঘোষ পদক (১৯৮১) প্রভৃতি সম্মাননা ও উপাধিতে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। তাঁর মৃত্যু কলকাতায়, ৩ মে ১৯৮৮।  [সৌমিত্র শেখর]