মারমা

মারমা  বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী। মারমা জনগণের অধিকাংশই বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে বসবাস করে। প্রায়শই তাদের আলাদা জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখা হয়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মারমা জনসংখ্যা ১,৫৭,৩০১। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে তাদের সংখ্যা আলাদাভাবে দেখানো হয়নি।

মারমারা মঙ্গোলয়েড বর্ণগোষ্ঠীর অন্তর্গত। মারমাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, মারমাদের ভাষা ‘ভোট বর্মী’ শাখার বর্মী দলভুক্ত একটি ভাষা। বর্ণমালার নাম ম্রাইমাজা। বাম থেকে ডান দিকে লেখার রীতি অনুসারী বর্ণমালা উপমহাদেশীয় প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপি হতে উদ্ভুত। মারমারা বিভিন্ন উপগোত্রে বিভক্ত যেমন: খ্যংসাঃচ্গাঃ, কক্দাইংসাঃচ্গাঃ, ওয়ায়ইংসাচ্গাঃ, মারোঃসাচ্গাঃ, কক্ফ্যাসাঃচ্ড়া প্রভৃতি।

নিজস্ব পোশাকে মারমা তরুণী

মারমা জনগণের বাড়িঘর বাঁশ, পাহাড়ি ছন ও ঘাসের তৈরি। এসব বাড়িঘর মূলত বাঁশ দিয়ে উঁচু মাচাং-এর উপর তৈরি করা হয়। বাড়ির প্রত্যেকটি কক্ষই একাধারে শয়নকক্ষ ও গুদামঘর। মাচাং-এর নিচের জায়গাটি গবাদিপশু রাখা, জ্বালানি কাঠ সংরক্ষণ অথবা তাঁত স্থাপনের মতো নানাবিধ কাজে ব্যবহূত হয়। কিছু কিছু বাড়ি মাটির তৈরি এবং মাচাং-বিহীন। ভাত এবং সিদ্ধ করা শাকসবজি মারমাদের প্রধান খাদ্য।

পূর্বে মারমা পুরষেরা ‘দেয়াহ্’ (ধুতি) নামে এক প্রকার তাঁতে তৈরি কাপড় পরতো। তারা এদেয়াহু সাথে বারিস্টা অাঁঙ্গি পরিধান করে। পুরুষের ‘খবং’(পাগড়ি) পরে। মেয়েরা ‘বেদাই আঙগি’ নামক এক ধরনের ব্লাউজ পরেন। মেয়রো যে কাপড় দিয়ে বুক ডাকে তাকে ‘রাংকাই’ বলে। মেয়েরা নিম্নাগ্নে বিশেষ ‘থ্বিং’ বা ‘থামি’ পরিধান করে। স্বামী হলো পরিবার প্রধান, তবে পরিবারে স্ত্রীর ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মারমা সমাজে আত্মীয়তার বন্ধন খুবই শক্তিশালী, এ জাতীয় সম্পর্ক বৈবাহিক এবং রক্ত সম্পর্কীয় উভয় ধরনের হয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রাচীন বার্মার থামোহাডা নামে পরিচিত উত্তরাধিকার নীতি অনুসরণ করা হয়। পুত্র ও কন্যা উভয়েই পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে।

মারমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। ধর্মীয় উৎসব হিসেবে তারা ক্ছংলাপ্রে বা বুদ্ধ পূর্ণিমা, ওয়াছো বা আষাঢ়ী পূর্ণিমা এবং ওয়াগোয়াই বা প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে। প্রবারণা উৎসবের রাতে আকাশে রঙ্গিন ফানুস উড়ানো হয়। রথ যাত্রা হয়। মার্মাদের সবচেয়ে বড় উৎসব সাংগ্রাই। এদিন বয়স্করা শীল পালন করে। তরুণ-তরুণীরা মৈত্রী পানি ছিটিয়ে একে অপরের মঙ্গল কামনা করে। পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। বুদ্ধ পূজা করা হয়। করা হয় বয়স্ক পূজাও। বয়স্ক পূজার মধ্য দিয়ে সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিদের সন্মান জানানো হয়।

মারমা জনগণের প্রধান পেশা কৃষি।  জুমচাষ তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রাথমিক কৃষিজ প্রয়াস। অবশ্য এর পাশাপাশি তারা পাহাড়ি অরণ্য থেকে গাছের পাতা, মূল এবং কন্দ সংগ্রহের মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। মারমা জনগণের মধ্যে বসতবাড়ি-সংলগ্ন ভিটায় ক্ষুদ্র আকৃতির বাগানচাষও দেখা যায়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে ঝুড়ি তৈরি, চোলাই মদ তৈরি এবং মজুরি শ্রম। বস্ত্রতৈরি মারমা মেয়েদের মধ্যে একটি খুবই সাধারণ কর্মকান্ড।

মারমাদের প্রদীপ নৃত্য

জাতপোয়ে নামক পালা ও ইয়েনপোয়ে নামক নৃত্য হচ্ছে জনপ্রিয় বিনোদন। মারমা সমাজে জ্ঞানী-গুণীজন এবং গীতিকারেরা ‘বিদ্ গাইট’ (ধর্মীয় শাস্ত্র), ‘বিদাং’ (জ্যোতিষশাস্ত্র) প্রভৃতি হতে মারমাদের কাহিনী সংগ্রহ এবং তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার আলোকে সমাজের বাস্তব রূপ ও  কাহিনী তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সংগীত ও গীতিনাট্য রচনা করেন। মারমা সংগীতের প্রধান প্রধান ধারাগুলি হলো: কাপ্যা, চাগায়াঙ, সাখ্রাঙ, রদু:, লাঙ্গা, সাইঙগ্যাই, লুঙটি প্রভৃতি। যন্ত্রসমূহের মধ্যে সেইং ওয়েইং (বৃত্তাকার বড় আকৃতির কাঠের ঢোল), কিয়ে ওয়েইং (ছোট আকৃতির কাঠের ঢোল), পিলিঈ (বাঁশি) এবং ঝিনে গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল যন্ত্রের সাথে বার্মায় ব্যবহূত বাদ্যযন্ত্রের মিল রয়েছে।

মারমা বংশ এবং রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় এ দুটি সংজ্ঞার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। ভাই ও বোনকে একই রক্ত সম্পর্কীয় বা পিতৃপরিচয় ধরে গণনা করলেও তাদেরকে আবার বংশগত দিক থেকে পৃথক হিসাবে দেখা হয়। যেমন বংশের ক্ষেত্রে মেয়ে মায়ের বংশ এবং ছেলে সব সময় বাবার বংশ পরিচয় লাভ করে। বিবাহ বিচ্ছেদে নারী এবং পুরুষ উভয়ের সমান অধিকার রয়েছে, তথাপি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে কারবারি (গ্রামপ্রধান) অথবা হেডম্যান (মৌজা বা এলাকাপ্রধান)-এর আদালতে।

মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে তিন স্তরবিশিষ্ট প্রথাগত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। গ্রাম পর্যায়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন একজন কারবারি। মৌজা পর্যায়ের প্রধান হলেন একজন হেডম্যান এবং সার্কেল প্রধান হলেন রাজা। গ্রামের কারবারি মৌজার হেডম্যান এবং সার্কেল প্রধানের মূল দায়-দায়িত্ব হলো জুম ট্যাক্স সংগ্রহ করা। এর পাশাপাশি তাদের ওপর নিজ নিজ প্রশাসনিক স্তরে বিরোধ নিষ্পত্তি, রায় প্রদান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়-দায়িত্ব অর্পিত।  [সাদাত উল্লাহ খান]