মহাভারত

মহাভারত  কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। চন্দ্রবংশীয় কুরু-পান্ডবদের ভ্রাতৃবিদ্বেষ ও যুদ্ধ এর মূল উপজীব্য। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা (দুর্যোধনাদি শতভাই) প্রপিতামহ কুরুর নামানুসারে কুরু বা কৌরব এবং পান্ডুর পুত্ররা (যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভাই) পিতার নামানুসারে পান্ডব নামে পরিচিত। কুরুপক্ষের প্রধান দুর্যোধন, আর পান্ডবপক্ষের প্রধান যুধিষ্ঠির। কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে এঁদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে কুরুপক্ষের সহায়তায় প্রধানত ছিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ, আর পান্ডবপক্ষে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।

মহাভারতের রচনাকাল নিয়ে মতবিরোধ আছে। প্রাচীনপন্থী পন্ডিতদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পূর্বে মহাভারত রচিত হয়, কিন্তু আধুনিক ও ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত হয়। প্রথম দিকে মহাভারত ‘জয়’ নামে পরিচিত ছিল, যার শ্লোকসংখ্যা ছিল ৮-১০ হাজার। যুগে যুগে প্রক্ষেপণের ফলে শ্লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে প্রচলিত মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা ন্যূনাধিক এক লাখ। শ্লোকগুলি ষোলো মাত্রিক চরণে রচিত।

ভারতের প্রায় সকল প্রাদেশিক ভাষায় মহাভারতের অনুবাদ হয়েছে। বাংলা ভাষায়ও হয়েছে, তবে বাংলা মহাভারত রচয়িতার নিজস্ব জীবনবোধ ও সমাজচেতনা এবং রচনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্যের কারণে তা মৌলিক কাব্যের মর্যাদা লাভ করেছে।

বাংলা মহাভারতের রচয়িতা একাধিক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি নিজের মতো করে মহাভারত  রচনা করেছেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিত কবীন্দ্র মহাভারত বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মহাভারত। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খানের নির্দেশে তাঁর সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে সংক্ষিপ্তাকারে এই অষ্টাদশপর্ব মহাভারত রচনা করেন। এজন্য এর আরেক নাম হয় পরাগলী মহাভারত।

অন্য একটি মতে সঞ্জয় রচিত মহাভারত প্রথম বাংলা মহাভারত। এছাড়া পরাগল খানের পুত্র ছোটে/ছুটি খানের (প্রকৃত নাম নসরৎ খান, ১৫১৯-৩২) নির্দেশে তাঁর সভাকবি শ্রীকরনন্দীও বাংলায় জৈমিনি মহাভারতের অশ্বমেধপর্বের ভাবানুবাদ করেন। এর অপর নাম ছুটিখানী মহাভারত। ষোড়শ শতকের কবি নিত্যানন্দ ঘোষ বৃহদাকারে মহাভারত রচনা করেন যা পশ্চিমবঙ্গে সমধিক প্রচলিত ছিল। এ শতকেই উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সভাকবি দ্বিজ রঘুনাথ রচিত ‘অশ্বমেধপর্ব’, উত্তর রাঢ়ের কবি রামচন্দ্র খানের ‘অশ্বমেধপর্ব’ এবং কোচবিহারের রাজসভার কবি রামসরস্বতীর ‘বনপর্ব’ এবং পীতাম্বর দাসের ‘নলদময়ন্তী উপাখ্যান’ও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

সপ্তদশ শতকে কাশীরাম দাস পদ্যে মহাভারত রচনা করেন, যা বাঙালিদের নিকট সর্বাধিক জনপ্রিয়। কাশীদাসী মহাভারত আঠারো পর্ব এবং একশত পর্বাধ্যায়ে বিভক্ত। আদিপর্বে বংশ বিবরণ, জতুগৃহদাহ, পঞ্চপান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ; সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরের দ্যূতক্রীড়া ও পরাজয়বরণ; বনপর্বে পান্ডবদের বনগমন; বিরাটপর্বে বিরাটের গৃহে পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস; উদ্যোগপর্বে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি; ভীষ্মপর্বের সূচনায় গীতা এবং পরে যথাক্রমে দ্রোণ, কর্ণ, শল্য ও সৌপ্তিক পর্ব পর্যন্ত কৌরব-পান্ডবের যুদ্ধ; স্ত্রীপর্বে স্বামিহারা স্ত্রীদের বিলাপ; শান্তিপর্ব ও অনুশাসনপর্বে রাজধর্ম; অশ্বমেধপর্বে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান; আশ্রমবাসিকপর্বে ধৃতরাষ্ট্র প্রমুখের আশ্রমবাস; মৌষলপর্বে যদুবংশ ধ্বংস; মহাপ্রস্থানিকপর্বে পরীক্ষিৎকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে পান্ডবদের মহাপ্রস্থান এবং সর্বশেষ স্বর্গারোহণপর্বে যুধিষ্ঠিরের নরক দর্শন ও পরলোকগত অর্জুনাদিকে দর্শন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

কাশীরামের পরে মহাভারত রচয়িতা হিসেবে আরও যাঁদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন ঘনশ্যাম দাস, অনন্ত মিশ্র, রামনারায়ণ দত্ত, রামকৃষ্ণ কবিশেখর, শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ, কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, ষষ্ঠীধর সেন, তৎপুত্র গঙ্গাদাস সেন, বাসুদেব, ত্রিলোচন চক্রবর্তী, দৈবকীনন্দন, কৃষ্ণরাম, রামনারায়ণ ঘোষ, লোকনাথ দত্ত, রাজেন্দ্র দাস, গোপীনাথ দত্ত, গঙ্গাদাস সেন, সৃষ্টিধর সেন প্রমুখ। এঁদের রচনা অধিকাংশই অসম্পূর্ণ এবং এ কারণেই সেগুলি সুধীসমাজে তেমন প্রচার পায়নি। উনিশ শতকে কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং রাজশেখর বসুর গদ্যানুবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময় কেউ কেউ মহাভারতের  ইংরেজি অনুবাদও করেছেন।

মহাভারতে বিভিন্ন মত ও পথের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। এতে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব দর্শনের সমন্বয় প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এটি একাধারে মহাকাব্য, ইতিহাস, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, মোক্ষশাস্ত্র ইত্যাদি। এই মহাকোষগ্রন্থ প্রাচীন ভারতের এক বিশাল জ্ঞানভান্ডার। তখনকার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, গার্হস্থ্যবিদ্যা, ভক্তিবাদ, যুদ্ধনীতি, রোম্যান্টিক কল্পগাথা, অসংখ্য মিথ, জ্যোতির্বিদ্যা, সম্মোহনবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, নৃত্যবিদ্যা সবকিছুর সমাবেশ ঘটেছে মহাভারতে। গুরুত্বের দিক থেকে তাই একে বলা হয় পঞ্চমবেদ। প্রসিদ্ধ ধর্মদর্শনগ্রন্থ ভগবদগীতা এর ষষ্ঠ পর্বের অন্তর্ভুক্ত।

মহাভারতের চরিত্রসমূহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া-পাওয়া, লাভ-ক্ষতি, লোভ-মোহ, আশা-নিরাশা, ধর্ম-অধর্ম ও পাপ-পুণ্যের প্রতীক। এখানে ভীষ্মের মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব, ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির, মহীয়সী গান্ধারী, প্রাজ্ঞ বিদুর, ধৈর্যশীলা কুন্তী, বুদ্ধিদীপ্তা তেজস্বিনী দ্রৌপদী, বীর যোদ্ধা কর্ণার্জুন এবং মহান শ্রীকৃষ্ণ চিরস্মরণীয়। তাঁদের প্রত্যেকের জীবনদর্শনই মানুষকে উদ্দীপিত করে, অনুপ্রাণিত করে। অন্যদিকে আবার দুর্যোধন-দুঃশাসনের বিদ্বেষপরায়ণতা ও নীতিহীনতা, কুটিলবুদ্ধি শকুনি প্রমুখ যেন লোভ-লালসাপূর্ণ এক অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের প্রতীক।

বহু শতাব্দী ধরে ভাস-কালিদাস-রবীন্দ্র-নজরুল প্রমুখ কবি, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর্যশিল্পী মহাভারত থেকে তাঁদের সৃষ্টির অনুপ্রেরণা ও উপাদান লাভ করেছেন। এটি গণজীবন ও লোকসংস্কৃতির ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব অপরিসীম। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]