মধ্যস্বত্ব

মধ্যস্বত্ব  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-উত্তরকালে সৃষ্ট জমিদারি ও রায়তি স্বত্বের মধ্যস্থিত এক অভিনব স্বত্ব। আক্ষরিকভাবে মধ্যস্বত্ব হচ্ছে এমন একটি অধিকার যা জমিদারি বা রায়তি কোনটির মধ্যেই পড়ে না। বাংলার ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন স্বত্ব। মধ্যস্বত্বাধিকারী না মালিক, না ভূমি-কর্ষণকারী কৃষক। জমিদার ও রায়তের মধ্যস্থিত মধ্যস্বত্বাধিকারীরা উৎপাদনে জড়িত নয়। রায়তের খাজনা সংগ্রহ করে জমিদারের প্রাপ্য শোধ করে উদ্বৃত্ত অংশ ভোগ করা মধ্যস্বত্বাধিকারীর অধিকার। এ আয় সম্পূর্ণ অনর্জিত, কেননা উৎপাদনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। মধ্যস্বত্বাধিকারীকে কোনো শ্রেণিভুক্ত করে বিচার করা কঠিন, কারণ এরা কোন আলাদা শ্রেণির নয়। এদের মধ্যে রয়েছে জমিদার, তালুকদার, ধনী রায়ত, এমনকি সাধারণ কৃষকও। জমিদার যেমন মধ্যস্বত্ব কিনেছে, তেমনি মধ্যস্বত্বাধিকারীও জমিদারী স্বত্ব লাভ করেছে। নিছক মধ্যস্বত্বের অধিকারী এমনও অনেক আছে যারা ভূ-স্বত্বের বাইরে অন্য কোনও না কোনও পেশার সঙ্গে জড়িত। এক কথায়, মধ্যস্বত্বাধিকারী সব শ্রেণির মধ্যে সংমিশ্রিত। ভূমি নিয়ন্ত্রণে সব শ্রেণীর স্বার্থই একাধারে জমিদার, তালুকদার, মধ্যস্বত্বাধিকারী, রায়ত ইত্যাদি সবার সঙ্গে জড়িত। এ পরিস্থিতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল। এর ফলে ভূমিকে কেন্দ্র করে একটি বাজার সৃষ্টি হয়েছে যার প্রভাবে ভূমি নিয়ন্ত্রণে সৃষ্টি হয়েছে নানা বৈশিষ্ট্যের স্বত্ব।

বস্ত্ততপক্ষে মধ্যস্বত্বের অস্তিত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেও ছিল। তবে তখন তা সীমিত ছিল শুধু পতিত জমি আবাদের বেলায়। জঙ্গল বা জলাভূমি আবাদ করে ফসলি জমিতে পরিণত করা ছিল মুগল সরকারের একটি নীতি। আবাদ কার্যকে উৎসাহ দানের জন্য সরকার মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করেছিল। ঐ মধ্যস্বত্বাধিকারীর অনেককেই হয়ত আবাদশেষে নিয়মিত তালুকদার বা মিদারি সনদ প্রদান করা হয়েছিল। তবে বাংলার ভূমি নিয়ন্ত্রণে একটি জটিল সমস্যা হিসেবে মধ্যস্বত্ব চিহ্নিত হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর। নির্ধারিত তারিখে সরকারি রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে ভূমি নিলামে বিক্রয় করে বকেয়া আদায় করা হবে বলে একটি কঠোর আইন প্রণীত হয়, যা এখন সাধারণভাবে সূর্যাস্ত আইন বলে পরিচিত। সূর্যাস্ত আইনের চাপের মুখে অনেক জমিদার নিরাপত্তার অন্বেষণে মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করেছে। বস্ত্তত ঐসব মধ্যস্বত্ব ছিল একধরনের স্বত্বের ভিতরে আরেক স্বত্ব।

বর্ধমানের রাজাই হলেন প্রথম জমিদার যিনি সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পত্তনি নামক মধ্যস্বত্ব প্রবর্তন করেন, যে প্রথাটি কালে বাংলার সকল জেলায়ই ছড়িয়ে পড়ে। উনিশ শতকের প্রথম দশকে বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র তাঁর বিশাল জমিদারিকে অনেকগুলি খন্ডে বিভক্ত করে প্রতিটি খন্ড নগদ সেলামি এবং একটি অপরিবর্তনীয় নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা নিয়মিত পরিশোধের শর্তে পত্তন বন্দোবস্ত দেন। এটি আরেকটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। রায়ত ও জমিদারের মধ্যবর্তী এ স্বত্বাধিকারীর নাম দেওয়া হয় পত্তনিদার। এতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকরণে শর্ত থাকে যে, পত্তনিদার যদি নিয়মিত খাজনা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে জমিদার নিলামের মাধ্যমে জমি বিক্রয় করে বকেয়া আদায় করবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মহারাজা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপ থেকে রক্ষা পেলেন। অর্থাৎ সূর্যাস্ত আইনের চাপটি পত্তনিদারের ওপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম হলেন। তবে এ কৌশল পরে পত্তনিদাররাও প্রয়োগ করল। পত্তনিদার প্রায় একই শর্তে সৃষ্টি করল ‘দারপত্তনি’ বা দ্বিতীয় স্তর পত্তনি। এমনিভাবে দারপত্তনিদার সৃষ্টি করল ‘সেপত্তনি’ বা তৃতীয় স্তরের পত্তনি স্বত্ব। প্রত্যেক ধাপের পত্তনিদার চেষ্টা করেছে তার উপরকার চাপটি একটি নির্দিষ্ট আয়ের বিনিময়ে নিচের স্তরে হস্তান্তর করে স্বত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। সহজেই অনুমেয় যে, এ ব্যবস্থার চূড়ান্ত চাপ গিয়ে পড়েছিল রায়তের ওপর। উৎপীড়িত রায়তের স্বার্থের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সরকার ১৮১৯ সালের অষ্টম রেগুলেশনের মাধ্যমে পত্তনি ব্যবস্থাকে আইনানুগ করে। জমিদার কর্ত্তৃক পত্তনি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল বিদ্যমান আইনকে লঙ্ঘন করে। কিন্তু সরকার এ খেলাপকে অপরাধ গণ্য না করে বরং জমিদারকে পুরস্কৃত করল উক্ত অষ্টম আইনের মাধ্যমে। এর কারণ এ ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদার সরকারকে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানে সক্ষম হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ রায়তের স্বার্থ না দেখে শুধু নিয়মিত রাজস্ব সংগ্রহকেই অগ্রাধিকার দিল।

পত্তনি মধ্যস্বত্ব ছিল রায়তের নিকট থেকে নিয়মিত খাজনা সংগ্রহের একটি নিগ্রহমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে হাওলা স্বত্ব নামে আরেক ধরনের মধ্যস্বত্ব সৃষ্ট হয়েছিল যার ভিত্তি ছিল আবাদ। জঙ্গল-জলা পরিষ্কার করে কৃষি সম্প্রসারণ ছিল হাওলা মধ্যস্বত্বের লক্ষ্য। গ্রামীণ মজুর পাওয়া দুষ্কর বিধায় আবাদভূমিতে স্বত্ব প্রদান করে ভূমিহীন কৃষকদের আবাদে আকৃষ্ট করা ছিল হাওলা মধ্যস্বত্বের উদ্দেশ্য। সুন্দরবন অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকার জমিদার-তালুকদাররা নিজেদের আয় ও এস্টেট বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাওলা স্বত্ব প্রয়োগ করে। হাওলা মানে অর্পণ অর্থাৎ জঙ্গলভূমি পরিষ্কার করে কৃষি আবাদের দায়িত্ব অর্পণ। এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে রায়তরা আগ্রহী হলো এজন্য যে, জমি পুরোপুরিভাবে কৃষি উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত রায়ত খাজনামুক্ত ছিল। তদুপরি, আবাদ কর্মের জন্য হাওলাদার সুদমুক্ত ঋণ লাভ করত। এখন হাওলাদার এক পর্যায়ে একই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করল নিমহাওলা অর্থাৎ দ্বিতীয় স্তরের হাওলা। এমনিভাবে নিমহাওলাদার সৃষ্টি করল ওসাত হাওলাদার। এভাবে দেখা গেল যে, সুন্দরবন আবাদ অঞ্চলে বিশেষ করে বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে জমিদার ও প্রকৃত রায়তের মধ্যে তৈরি হলো বহুস্তরবিশিষ্ট একটি ভূম্যধিকারী শ্রেণি। এরা কোনও না কোনো শ্রেণির হাওলাদার। ভূ-জরিপে বাকেরগঞ্জ এলাকায় ন্যূনপক্ষে চারটি স্তর বা স্থানীয় ভাষায় ‘সেকা’ লক্ষ্য করা গেছে। তবে কোনো কোনো এলাকায় ষোলটি পর্যন্ত সেকার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এক কথায়, বিশাল সুন্দরবন এলাকাকে আবাদে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন স্তরের হাওলাদাররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

সব রকমের মধ্যস্বত্বের উদ্ভব ঘটেছে কোনও না কোনো স্থানীয় ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে এবং এগুলির কোনটিরই কোনো আইনগত বৈধতা ছিল না। সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্বের মাধ্যমে সব রকমের মধ্যস্বত্বকে বৈধতা প্রদান করা হয়। মধ্যস্বত্বাধিকারীরা একটি বৃহৎ শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয় উনিশ শতকের শেষ নাগাদ। বিশ শতকের নির্বাচনী রাজনীতি প্রবর্তিত হওয়ার ফলে তাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। তবে দেশ বিভাগের পর প্রায় একই সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থা বিলোপ করা হয় এবং এর সঙ্গে বিলোপ করা হয় সবরকম ও সকল স্তরের মধ্যস্বত্বও। ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট-এর অধীনে কৃষকের উপরিস্থিত সকল ভূ-স্বার্থ বিলুপ্ত করে প্রজাকে ভূমির মালিক বলে ঘোষণা করা হয়।   [সিরাজুল ইসলাম]