ভূমি জরিপ

ভূমি জরিপ  কোন নির্দিষ্ট জনপদে একটি নির্ধারিত হারে রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জমির অবস্থান, তার প্রমিত পরিমাপ ও মালিকানা নির্ণয়ের জন্য পরিচালিত জরিপ। সুলতান শেরশাহের (১৫৪০-৪৫) শাসনামলে প্রথমবারের মতো উপমহাদেশে ভূমি জরিপের গুরুত্ব সবিশেষ মনোযোগ লাভ করে। শেরশাহ ভূমি পরিমাপ, ভূমির কর নির্ধারণ ও কর আদায়ের একটি নিয়মিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তবে সম্রাট আকবরের অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রী তোডর মল (১৫৭১-৮২) জমির সঠিক কর নির্ধারণ, সেইসাথে জমির সর্বাঙ্গীণ জরিপ ও জমি পরিমাপের একটি একক ও অভিন্ন প্রমিতি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর কর নির্ধারণ ব্যবস্থার আওতায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সুবায় (প্রদেশে) জমির খাজনা বা ভূমিরাজস্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। এ সময় জমিতে উৎপন্ন ফসলের নির্ধারিত একাংশ হিসেবে খাজনা আদায় করা হতো। আর্থিক প্রশাসনের প্রধান হিসেবে দীউয়ান নিযুক্তির মাধ্যমে এই আমলের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তোডর মলের কর নির্ধারণ ব্যবস্থাটি ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় রাজস্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আগে পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। তবে এর আগে, ১৬৮৫ ও ১৭৫০ সালে এ ব্যবস্থার কিছু কিছু উন্নতি সাধন করা হয়। তাত্ত্বিক দিক থেকে, আবাদি জমির পরিমাপ ও জমির মাটির শ্রেণীবিভাগ বা বিন্যাসের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করা হলেও বাংলা ও তার বাইরের প্রদেশগুলিতে বাস্তবিকপক্ষে কোন জরিপ পরিচালনা করা হয় নি। সে সময় বেশ বড় বড় এলাকা কৃষিখামার বা তালুক হিসেবে আমিল বা রাজস্ব সংগ্রাহকের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আপাতদৃষ্টে জমির কর নির্ধারণ ও সংগ্রহের বিষয়টি ছিল আমিলদের নিজস্ব ব্যবস্থার আওতায়। ১৭৬৯ সন পর্যন্ত এ ব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, এরপর সাবেক শাসকরা বাঙালি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের কাজ দেখাশোনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। ১৭৭২ সালে এসব তত্ত্বাবধায়ককে জেলায় জেলায় রাজস্ব সংগ্রাহক কর্মকর্তা বা রেভিনিউ কালেক্টর করা হয়।

ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ওয়ারেন হেস্টিংস, সর্বোচ্চ ডাকে চাষিদেরকে পাঁচ বছরের জন্য তালুক বন্দোবস্ত প্রদানের এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এ ব্যবস্থা পাঁচসনা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। অবশ্য এই নতুন ব্যবস্থা নিদারুণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনাদায়ি ভূমিকর জমে উঠতে থাকে, রাজস্ব আদায় কমে যায়। এ অবস্থায় উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকবর্গ একটি উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পিট-এর ভারত আইন, ১৭৮৪ পাশ হয়। এই আইনের আওতায় স্থির করে দেওয়া হয় যে, ভারত সরকারকে দেশের জমিদারদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে স্থানীয় আইনকানুন, রীতি-আচারের ভিত্তিতে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য স্থায়ী বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হবে। ১৭৮৬ সনে লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতে আসার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের একটি নির্দেশপত্রও সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই পত্রের মর্মানুযায়ী, কোম্পানি পরিচালকরা একটি যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায্য রাজস্ব প্রদানের শর্তে ভারতে ভূমির স্থায়ী বন্দোবস্ত দানকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করেন। আর এ শর্ত পূরণসাপেক্ষে জমির এই স্থায়ী বন্দোবস্ত আর সেইসাথে তালুকে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার হবে একমাত্র সার্বিক নিরাপত্তা বিধায়ক ব্যবস্থা। প্রথমে ১৭৮৯-৯০ সনে এক দশসনা বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন করা হয়। আর এ ব্যবস্থায় জমিদার, স্বতন্ত্র সত্তার তালুকদার ও অন্যান্য ইজারদার ইত্যাদি মধ্যস্বত্বাধিকারীই প্রকৃতপক্ষে কর সংগ্রাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তবে ১৭৯৩ সনে, দশসনা বন্দোবস্তের শর্তগুলি ঐ বছরের ১নং নিয়ন্ত্রণবিধি অনুসারে স্থায়ী করা হয়। এই ব্যবস্থাটি ছিল চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। আজকের বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৯১% শতাংশ ছিল চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের আওতায়।

এই ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) সকল জমির নিয়মিত জরিপ কার্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৭৮৯ সন অবধি তৎকালীন তালুকগুলির সীমা, পরিসীমা ও আকার-আয়তন সম্পর্কিত সংগৃহীত তথ্য অসম্পূর্ণ ও সম্ভবত, কোন কোন ক্ষেত্রে খুবই ভ্রান্তিপূর্ণ ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জেলা কর সংগ্রাহক কর্মকর্তারা (ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর) ঐ বন্দোবস্তগুলিতে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ জমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা নির্ণয় করতে গিয়ে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হন। এ বিষয়ে যেসব দলিল-দস্তাবেজ জেলা কর সংগ্রাহক কর্মকর্তাদের হাতে ছিল সেগুলিতে ঐসব বন্দোবস্তে জমির সত্যিকারের সীমা-চৌহদ্দির বড়জোর একটি রূপরেখা থাকলেও তার সংজ্ঞা স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ছিল না। জমির চাষিরা প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের আবাদকার্য নিজ নিজ বন্দোবস্তির সীমা-চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বনজঙ্গল এলাকাতেও বাড়াতো। আর এভাবে চাষাবাদ সম্প্রসারিত হওয়ার পর জমিদাররাও এ ধরনের জমির জন্য যথারীতি খাজনা আদায় করতে থাকে, যদিও এরকম জমি প্রকৃতপক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীন ছিল না। ঐ সময় আবার মূল তালুকগুলি দ্রুত ভেঙে যেতে থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। বকেয়া খাজনা বা অন্যসব কারণে এসব তালুক বিক্রয় হয়ে যায়। এগুলি সরকার বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে ক্রয় করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই সরেজমিনে এ ধরনের অনেক তালুকের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ সকল এবং আরও অনেক কারণে স্থায়ী বন্দোবস্তের অধীন এলাকাগুলির দক্ষভাবে প্রশাসন পরিচালনা ক্রমেই কঠিন হয়ে ওঠায় রাজস্ব জরিপ বিশারদদের সাহায্য চাওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, এই তালুকগুলির সীমা-চৌহদ্দির স্থায়ী নিষ্পত্তি ও সেভাবে জমির মানচিত্র তৈরি এবং ভবিষ্যৎ বিরোধ-বিসম্বাদের আশঙ্কা দূর করার উদ্দেশ্যে এসব তালুক সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ করা।

অস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীন তালুকগুলির বেলায় অবস্থা ছিল ভিন্ন। এসব তালুকের ক্ষেত্রে সরকার সাধারণত সীমিত কয়েক বছরের জন্য একটি খাজনা বা ভূমিরাজস্ব নির্ধারণ করে দিত অথবা এগুলিকে বিভিন্ন আবাদি এলাকায় ভাগ করে দিয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিদের ইজারায় ছেড়ে দিত, আর তারাই আবার ঐ জমিতে প্রজাপত্তনি দিয়ে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। অবশ্য, উভয় ক্ষেত্রেই জমির প্রকৃত চাষিরা যাতে যথাযথ আচরণ পায় তার নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব ছিল সরকারের। এ কারণে, জমির রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৭৯৩-এ (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের বছর) স্থায়ী বন্দোবস্তের অধীন এলাকাগুলির বেলায় ইউনিট বা জোতের একক ছিল বিদ্যমান অবস্থাধীন তালুক, আর অস্থায়ী বন্দোবস্তি এলাকার জন্য ঐ ইউনিট বা জোত ধার্য হয় পুনঃবন্দোবস্ত প্রদানকালে ঐ চাষির মালিকানাধীন জোতের সমপরিমাণ জমি।

কোন এলাকা স্থায়ী বা অস্থায়ী যে কোন ভূমি বন্দোবস্তের আওতায়ই থাক না কেন, দেখা যায়, স্থানীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি রয়েছে এমন কোন গ্রামকে জরিপের সত্যিকার ইউনিট হিসেবে ধরে নেওয়াই ছিল সুবিধাজনক। কেবল প্রশাসনিক কারণেই নয়, পরিসংখ্যানগত উপাত্ত সংগ্রহের জন্যও এটি সুবিধাজনক। তাছাড়া, একটি গ্রাম সর্বদাই একটি ক্ষুদ্র ভূমি-ইউনিটও (জোত) বটে, যাতে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটত না বললেই চলে। পরগনা ছিল প্রাচীন জমিবিভাগ পদ্ধতির ইউনিট। তবে স্বীকৃত প্রশাসনিক জোত-ইউনিট হিসেবে পরগনা ক্রমান্বয়ে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, তারপরও রাজস্ব জরিপের বিবেচনায় পরগনা বিপুল গুরুত্বের দাবিদার, কেননা জরিপের রেকর্ড বা নথিপত্র প্রধানত পরগনাভিত্তিতেই সংগ্রহ করা হতো।

অতীতে যেসব বড় ধরনের জরিপ কার্যক্রম প্রচলিত ছিল সেগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:

থাকবস্ত জরিপ (১৮৪৫-১৮৭৭) ১৮৪৫-৭৭ মেয়াদে রাজস্ব জরিপের বেলায় সর্বদাই পূর্বশর্ত হিসেবে একটি থাকবস্ত বা চৌহদ্দি চিহ্নিতকরণ জরিপ পরিচালিত হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল, জরিপের অধীন সকল গ্রাম ও তালুকের মধ্যকার সীমা-চৌহদ্দিগুলি সরেজমিনে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করা। কার্যত, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা রাজস্ব জরিপ শুরুর আনুমানিক এক বছর আগে গ্রাম ও তালুকগুলির প্রকৃত সীমা-চৌহদ্দি সরেজমিনে চিহ্নিত করার জন্য যেতেন। সীমা-চৌহদ্দি সম্পর্কিত সকল বিরোধ এভাবে আগে থেকেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকার ফলে রাজস্ব জরিপ কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সময় কোনরকম বিলম্ব ছাড়াই সাবলীল গতিতে সম্পন্ন করতে পারতেন।

থাকবস্ত জরিপের প্রকৃত ইউনিট বা জোত একটি গ্রাম হওয়ার কারণে যে খসড়া নকশা বা ম্যাপ তৈরি করা হতো তাতে একটি পরগনার আওতায় সকল গ্রামকে দেখানো হতো। সেইসাথে বিভিন্ন গ্রামের জন্য বরাদ্দ নাম ও নম্বরযুক্ত একটি তালিকাও প্রণয়ন করা হতো। এ মানচিত্রটি অভিহিত হতো থাক মুজমিলি নামে। এতে সীমা-চৌহদ্দি নির্ধারক কর্মকর্তা কর্তৃক স্বীকৃত সকল গ্রামের নাম ও ঐসব গ্রামের থাক নম্বর থাকত। পরিশেষে, রাজস্ব জরিপ কর্মকর্তা ঐ গ্রামগুলির জন্য জরিপ নম্বর বরাদ্দ করতেন। প্রতিটি পরগনায় থাক জরিপের লব্ধ ফলগুলি রাজস্ব জরিপ কর্মকর্তাকে হস্তান্তর করা হতো যাতে তিনি তা থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেতে পারেন। থাক জরিপ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা সাধারণত ছিলেন একজন কর সংগ্রাহক কর্মকর্তার পূর্ণ ক্ষমতাধারী বিশেষ অধিকারভোগী আমলা। ১৮৫২ সালের আগে প্রণীত থাক মানচিত্রগুলির বেশিরভাগই ছিল চোখে দেখার ভিত্তিতে অাঁকা নকশাবিশেষ। তবে পরের দিকে তৈরি এ রকম কিছু নকশার মান ছিল একটু উন্নত। আর এসবের মধ্যেও সর্বশেষ পর্যায়ে তৈরি কিছু মানচিত্র যুক্তিসঙ্গতভাবেই নির্ভুল বলে বিবেচিত। অবশ্য, এই মানচিত্র বা নকশাগুলির উদ্দেশ্য ছিল, রাজস্ব জরিপ কর্মকর্তাকে মোটামুটি একটা নির্দেশক রূপরেখা দেওয়া, তার বেশি কিছু নয়। থাক মানচিত্রের স্কেল ছিল বিভিন্ন। চোখে দেখা ধারণায় অাঁকা নকশাগুলির অবশ্য কোন স্কেলে তৈরি করা হয় নি। অন্যান্য সব মানচিত্র ৪ ইঞ্চি = ১ মাইল থেকে শুরু করে ২৪ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেলে অাঁকা।

রাজস্ব জরিপ (১৮৪৬-১৮৭৮)  থাক জরিপের উপাত্ত ও জমির জন্য বরাদ্দ সংখ্যার ওপর ভর করে রাজস্ব জরিপ কর্মকর্তা তাঁর কাজ শুরু করতেন। ভূ-সংস্থানগত বিবরণসহ গ্রামের সীমা-চৌহদ্দি, কোন কোন ক্ষেত্রে তালুকের সীমানার নির্ভুল মানচিত্র তৈরি, সাধারণ প্রশাসনিক কাজের জন্য কিছু উপাত্ত প্রণয়ন, প্রতিটি গ্রামের মানচিত্র (সাধারণত, ৪ ইঞ্চি =১ মাইল) ও পরগনার মানচিত্র (সাধারণত, ১ ইঞ্চি = ১ মাইল) প্রণয়ন ছিল রাজস্ব জরিপের উদ্দেশ্য। কোন গ্রামের অভ্যন্তরের বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিবরণ এতে প্রদর্শন করা হয়। আর এটি বস্ত্ততপক্ষে এমন প্রাথমিক বা মৌল বিষয় যার বুনিয়াদে পুরো জরিপ কাজটি পরিচালিত হয়ে থাকে। এই মূল বা বুনিয়াদটি তত্ত্বগতভাবে বিরাট এক ত্রিকোণমিতিক জরিপের (১৮৪০-১৮৬৫) একটি কেন্দ্রবিশেষ। এ জরিপের প্রতিবেদন বিস্তারিত দুটি শিরোনামের আওতায় বিবেচনা করা যায়: সীমা-চৌহদ্দি ও ভূ-সংস্থানগত বিবরণ। এ জরিপের অভ্যন্তরীণ বিশদ বিবরণকে সঠিক ও নির্ভুলভাবে জরিপকৃত বলে গণ্য করা যায়, কেননা আড়াআড়ি অবস্থানের জরিপ কেন্দ্রগুলি পর্যাপ্ত বিন্দু ও ভিত্তির (ভূমি) সুবিধা দেয়, যার ভিত্তিতে খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যগুলিরও মানচিত্রণের সুবিধা পাওয়া যায়। এর কারণ এই যে, রাজস্ব জরিপের সবচেয়ে নির্ভুল কাজ হয়েছে আড়াআড়ি জরিপ পদ্ধতিতে আর এতে কেবল আড়ি (cross) বিন্দুগুলিই ছিল রিলে কাজে গ্রহণযোগ্য, অবশ্য সেগুলি যদি পাওয়া সম্ভব হয়। রাজস্ব জরিপ গোটা দেশের উপরিতল এলাকার পরিমাপ নিয়েছে এবং একটি নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে একেকটি গ্রামকে তার গোটা জমি বা ভূমি বরাদ্দ করেছে। রাজস্ব জরিপে লব্ধ ফল সাধারণত পরগনা মানচিত্র (১ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেল) তৈরিতে ব্যবহূত হয়েছে। পরে, সার্ভেয়র জেনারেল এই এক ইঞ্চি স্কেলের মানচিত্রগুলিকে ১ ইঞ্চি স্কেলের জেলা মানচিত্র ও ৪ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেলের মানচিত্রকে ভারতবর্ষের মানচিত্র তৈরিতে ব্যবহার করেন।

খসড়া জরিপ কার্যক্রম (১৮৪৬-১৮৫৪) অস্থায়ী বন্দোবস্তাধীন জমিতে এবং স্থায়ী জমিতে বিভিন্ন স্বত্ব জট পাকিয়ে থাকার কারণে ও থাক মানচিত্রে কিংবা থাকবস্ত জরিপের কাগজপত্রে সরেজমিন খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত প্রদর্শন ব্যয়বহুল বলে এ ধরনের জমিতে খসড়া জরিপ কার্যক্রম পরিচালনাই সাধারণ রীতি। এ কাজে সাধারণত ১৬ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেলই ব্যবহূত হয়। এ জরিপের আওতায় সংগৃহীত বিস্তারিত বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে প্লট বা জমির দাগ নং, কালেক্টরের রেন্ট রোল-এর তৌজি নম্বর, তালুকের নাম, স্বত্বাধিকারীর নাম, চাষি বা প্রজার নাম, জমির (দাগ/প্লটের) বিবরণ, এলাকার নাম, উৎপাদিত ফসলের নাম ইত্যাদি। খসড়া মানচিত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তৈরি করা হয় না। আর যদি করাও হয় তাহলেও সেগুলি অধিকাংশই নির্ভুল নয়, অসম্পূর্ণও বটে। তবে খসড়া জরিপের মানচিত্র আধুনিক কালের সিএস জরিপ বা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভের মানচিত্রের অনেকটাই কাছাকাছি। আজকের প্রচলিত সিএস পদ্ধতির জরিপ উনিশ শতকের সত্তরের দশকে প্রথমবারের মতো যুক্তপ্রদেশে (বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশ) ব্যাপক পর্যায়ে কাজে লাগানো হয়। পরে এই জরিপ ব্যবস্থা পূর্ববঙ্গসহ (আজকের বাংলাদেশ) সমগ্র বাংলায় সম্প্রসারিত হয়। কর্নেল জে.আর স্যান্ডিম্যন বাংলায় এই পদ্ধতি প্রথম প্রবর্তন করেন ও বাংলা প্রদেশ (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) জরিপ বিভাগের প্রথম পরিচালক হিসেবে পূর্ববঙ্গের জরিপগুলিতে এর ব্যাপক ব্যবহার করেন। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার জরিপ বিভাগীয় পরিচালক ছিলেন লে. কর্নেল আর.টি ক্রিচটন। তিনি তাঁর অঞ্চলে তৎকালীন বিরাজমান অবস্থা অনুযায়ী ঐ পদ্ধতিতে নানা রদবদল করেন।

দিয়ারা জরিপ (১৮৬২-১৮৮৩)  ১৮৪৭ সনের ৯ নং আইনে সন্নিবিষ্ট বিধানের আওতায় বাংলার গঙ্গা ও অন্যান্য বড় নদীর গর্ভদেশ এলাকা ৪ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেলে জরিপ করা হয়। ১৭৮৯ সনের দশসনা বন্দোবস্তের পর থেকে এ যাবৎ গঠিত নতুন ভূমি নিরূপণের একটি ভিত্তি বের করার জন্য এসব জরিপ পরিচালনা করা হয়। দিয়ারা জরিপ থেকে লব্ধ ফলগুলির কারণে নির্ভুল তুলনামূলক মানচিত্র তৈরি করা সুবিধাজনক হয়েছে। এই মানচিত্রে রাজস্ব, দিয়ারা (নদীগর্ভ এলাকা) ও ভৌগোলিকভাবে আধুনিক সীমা প্রদর্শন করা যায়। এই জরিপ কাজের গুরুত্ব সমধিক এ কারণে যে, এই জরিপ প্রায় ক্ষেত্রেই নদীগর্ভ এলাকা নিয়ে বিবাদ-বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সত্যিকার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বাংলার ব্যাপারে বলা চলে, ১৮৬২-৬৫ মেয়াদে গোটা গঙ্গা নদী ও উত্তর-পশ্চিম বিহারের কোন কোন নদীর জরিপ পেশাদারি মানে সম্পন্ন করা হয়।

কিশত্ওয়ার জরিপ (Cadastral Survey)  সত্যিকার অর্থে আধুনিক কিশত্ওয়ার জরিপ খসড়া জরিপের উন্নততর সংস্করণ। খসড়া জরিপ চলত রাজস্ব জরিপের আগে। কিশত্ওয়ার জরিপ পদ্ধতি আড়ি জরিপ, কিশত্ওয়ার কার্যক্রম ও ভূবাসন কার্যক্রম  এই তিন অংশে বিভক্ত। আড়ি জরিপের কাজ করতেন পেশাদার জরিপ বিশারদগণ। এই কাজটি বাস্তবিকপক্ষে রাজস্ব জরিপে পরিচালিত আড়ি কার্যক্রমেরই অপর ভাগ। তবে এই কার্যক্রমে কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা উন্নত পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। কিশত্ওয়ার পর্যায়ের কার্যক্রম ভূপৃষ্ঠের জমির বিষমকোণী প্লট/ক্ষেত্রগুলিকে মোটামুটি আকারের কয়েকটি চতুষ্কোণ ক্ষেত্রে বিভক্ত করে। এই ক্ষেত্রগুলি প্রত্যেকটি হয় গড়ে পনেরো থেকে পঁচিশ একরের মতো জমি। চতুষ্কোণ ক্ষেত্রগুলির ভিত্তি বা বুনিয়াদ অবস্থিত থাকে আড়াআড়ি রেখাগুলির বিন্দুসমূহের উপর। এরপর এই চতুষ্কোণ ক্ষেত্রগুলিকে মোটামুটি আয়তক্ষেত্রে উপবিভক্ত করা হয় আর এগুলির একেকটির আয়তন তখন দাঁড়ায়, কী কী খুটিনাটি বিষয় জরিপ করতে হবে তার সূক্ষ্ম জটিলতা সাপেক্ষে দুই থেকে চার একর। বিভিন্ন চতুষ্কোণ ক্ষেত্রের পাশগুলি থেকে একটি গ্রামের ভিতরের সকল খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য সহকারে অপটিকাল স্কয়ার ও পরিমাপক চেইন ব্যবহারের মাধ্যমে মানচিত্র তৈরি করা যায়।

কিশত্ওয়ার কার্যক্রমের ফল হিসেবে তৈরি হয় একটি মানচিত্র যা কার্যত সর্বদাই প্রতিটি গ্রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে থাকে ১৬ ইঞ্চি = ১ মাইল স্কেলে। এই মানচিত্রে গ্রামগুলির যথার্থ অবস্থান ও সেগুলির আবাদি জমির সত্যিকারের সীমা-চৌহদ্দি প্রদর্শিত হয়। কিশত্ওয়ার জরিপের কাজ আগে জরিপ বিভাগ পরিচালনা করত। এই জরিপকে সাবেক খসড়া জরিপের অপর (পাল্টা) ভাগ হিসেবে গণ্য করা যায়। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে খসড়া জরিপের সাথে কিশত্ওয়ার জরিপের ভিন্নতা রয়েছে, যেমন, এই জরিপের আওতায় জমি বা প্লটকে তার মোটামুটি গড় আকারে না দেখিয়ে এর প্রকৃত আকৃতিতে দেখানো হয়। এসব ক্ষেত্র বা জমির আয়তন সরাসরি ম্যাপ থেকে পরিগৃহীত হয় বলেই সরেজমিনে তৈরি মূল নকশা বা মানচিত্র থেকে যান্ত্রিক উপায়ে তা পুনরুৎপাদন করা যায় আর ক্ষেত্র বা জমির সীমা নিখুঁতভাবে কিশত্ওয়ার মানচিত্র থেকে নিয়ে এতে বসিয়ে দেওয়া যায়।

বিমান জরিপ  বাংলাদেশের পরিবেশ ও অবস্থা বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিশ্ত্ওয়ার মানচিত্রণের জন্য বেশ উপযোগী। আর এ কাজটি করা যেতে পারে উল্লম্ব বিমান আলোকচিত্র পদ্ধতিতে। বাংলাদেশের বেলায় এ পদ্ধতির প্রধান সুবিধা হলো, দেশটি সমতল আর জমির সীমা-চৌহদ্দিগুলি আকাশ থেকে ভাল করেই পরিদৃশ্যমান। তবে এ ধরনের কোন মানচিত্র প্রণয়নকর্মই স্পষ্টত সন্তোষজনক হয় না, কেননা জমির বিভিন্ন এলাকা নানারকম গাছপালা ও বাস্ত্তভিটার ঝোপঝাড়ে অস্পষ্ট হয়ে উঠতেই পারে, যার ফলে বিস্তারিত খুঁটিনাটি বা ভূমির অন্যান্য তথ্যও চাপা পড়তে পারে। অবশ্য, পল্লী জনপদের অপেক্ষাকৃত খোলা এলাকাগুলির বেলায় এই জরিপ বেশ উপযোগী হতে পারে, তবে সেক্ষেত্রেও মানচিত্র প্রণয়নের স্কেল ক্ষুদ্রতম প্লট চিহ্নিত করার জন্য পর্যাপ্ত রকমে বড় হতে হবে। ১:১২,০০০ অনুপাতের স্কেল সম্ভবত বাংলাদেশের প্রায় সকল স্থানের জন্যই যথেষ্ট হবে। কিন্তু তারপরেও এ ধরনের সব এলাকাতেও, আকাশ থেকে নেওয়া আলোকচিত্র সব চাহিদা পুরোপুরি মিটাতে সক্ষম হবে না। কারণ, ঝোপঝাড়ময় বাস্ত্তভিটা এলাকাগুলির বিবরণ সম্পূর্ণভাবে পেতে হলে তার জন্য সরেজমিনে মাঠজরিপ সর্বদাই আবশ্যক হয়ে থাকে। তদুপরি, আকাশ থেকে তোলা আলোকচিত্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এই ব্যয় সর্বদা লাভজনক নাও হতে পারে।

রিমোট সেন্সিং (কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক জরিপ)  বিমান থেকে আলোকচিত্র গ্রহণের মতোই কোন কোন নির্বাচিত এলাকার জন্য রিমোট সেন্সিং ব্যবস্থায় চিত্রগ্রহণ ফলদায়ক বলে বিবেচিত হতে পারে। চর এলাকাগুলির দিয়ারা জরিপে অনেক গলদ রয়েছে। সেদিক থেকে দূর আকাশের কক্ষপথে স্থাপিত কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে রিমোট সেন্সিং ব্যবস্থায় সংগৃহীত উপাত্তগুলি উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করার কাজে সহায়ক হতে পারে। বাস্তবিক পক্ষেও জরুরি ভিত্তিতে এসব এলাকার জরিপ হওয়া দরকার। রিমোট সেন্সিং ভূমির পরিমাণগত পরিমাপ দিতে সক্ষম। আর তাতে নতুনভাবে ঐসব গড়ে ওঠা কিংবা জেগে ওঠা ভূমির এখতিয়ার নির্ণয়ের প্রশাসনিক সমস্যাও লাঘব হতে পারে। বাংলাদেশ জরিপ বিভাগ ও স্পারসো (SPARSO) সরকারের উদ্যোগে গৃহীত পাইলট প্রকল্পে সহায়তা দিতে পারে। একই উদ্দেশ্যে এমন উদ্যোগের ব্যয় সার্থকতা বা সাশ্রয় কতটুকু হতে পারে, তাতে কী ধরনের উপকার পাওয়া যাবে এখন তার নিরূপণ প্রক্রিয়া চলছে।  [তফাজ্জল হুসেন]