ব্যবসায় শিক্ষা

ব্যবসায় শিক্ষা  শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে বাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবসার ভূমিকা অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও উন্নয়নের সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন ও বিস্তৃতি ঘটেছে। পাশাপাশি ব্যবসা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবসায় শিক্ষা বলতে পূর্বে করণিক, সাচিবিক বা হিসাব সংরক্ষণ, দাপ্তরিক যন্ত্রপাতি পরিচালনা সম্পর্কিত জ্ঞান বুঝাত। তবে প্রকৃতপক্ষে ব্যবসায় শিক্ষা বলতে জ্ঞান জগতের এমন বিষয়কে বুঝায় যা পাঠ করলে একজন ব্যক্তি ব্যবসা স্থাপন ও তা সাফল্যের সাথে পরিচালনা করতে সমর্থ হয়। যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সঙ্গে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থাপনা নীতি ও কলাকৌশল সংক্রান্ত জ্ঞানই ব্যবসায় শিক্ষা। কিন্তু ব্যবসায় শিক্ষার পরিধি আরও ব্যাপক। এ শিক্ষা সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, কাঙ্ক্ষিত খাতে বিনিয়োগ এবং অর্জিত আয়ের যথাযোগ্য ব্যবহারের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। ব্যবসায় শিক্ষা একজন ব্যক্তির জ্ঞানকে ব্যবসায়িক পরিবেশ উপযোগী করে তৈরির প্রক্রিয়া। এটি শিক্ষানবীশ পদ্ধতির একটি অগ্রবর্তী পর্যায় বুঝায় যা যুবকদের ব্যবসায় পেশার জন্য প্রস্ত্তত করে তোলে।

বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষার সূচনা ব্রিটিশ আমল থেকেই। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক ব্যবসায় শিক্ষার পথ সুগম হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর সরকার শিল্পখাত উন্নয়নে মানব সম্পদের চাহিদা পরিমাপ করার লক্ষ্যে বাণিজ্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। বিশেষজ্ঞরা এ সময় বাণিজ্য শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা চালু করার সুপারিশ করেন। ঐ সময়ে বাণিজ্য শিক্ষা বলতে এ অঞ্চলে বি.কম পাশ ডিগ্রি বুঝাত। উক্ত প্রোগ্রামের বিষয় বস্ত্তর মধ্যে অর্থনীতি, মুদ্রা ও ব্যাংকিং, বীমা, ব্যবসা সংগঠন, পরিবহণ, বাণিজ্যিক ভূগোল, বাণিজ্যিক আইন, বাণিজ্যিক ইংরেজি ছিল অন্যতম। ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ২ বছর মেয়াদি এম.কম ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু ছিল। কিন্তু ২ বছর মেয়াদি ডিগ্রি প্রোগাম অপ্রতুল বিবেচনায় ১৯৫৩ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিন বছর মেয়াদি বি.কম (সম্মান) কোর্স প্রবর্তন করা হয়। সম্মান গ্র্যাজুয়েটদের এক বছর এবং পাশ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য দুই বছর মেয়াদে এম.কম ডিগ্রি প্রোগ্রাম বিদ্যমান ছিল। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০ বছরের পাঠ সমাপনান্তে একজন ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কলা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের যে কোন একটি বিষয়ে পড়তে পারতো। বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে ছাত্রদের উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ শেষে ডিগ্রি পর্যায়ে একাধিক বিভাগে ভর্তির সুযোগ থাকলেও বাণিজ্যের ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র বাণিজ্য বিভাগেই ভর্তির সুযোগ ছিল। ফলে বাণিজ্যের ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিল খুবই সংকুচিত। এ অবস্থায় ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে বাণিজ্যের ছাত্রদের জন্য আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগকে অনুষদে উন্নীত করার দাবী উঠে। বিগত কয়েক দশকে উন্নত বিশ্বে ব্যবসায় শিক্ষার প্রসার এবং বাংলাদেশের শিল্প বাণিজ্য খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপকের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এ দাবী ছিল খুবই সময়োপযোগী ও কাঙ্ক্ষিত। উনিশ শতকের সত্তুরের দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্য অনুষদ স্থাপনের দাবী আরো জোরদার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অচিরেই দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসায় শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং বাণিজ্য বিভাগকে বাণিজ্য অনুষদে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স ও মার্কেটিং এ চারটি বিভাগ নিয়ে অনুষদ গঠনের পরিকল্পনা করা হলেও অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে ১৯৭০ সালের জুলাই মাস থেকে হিসাব বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা এ দুটি বিভাগ নিয়ে বাণিজ্য অনুষদ যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই থেকে ফিন্যান্স ও মার্কেটিং বিভাগ স্থাপন করা হয়। ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও বাণিজ্য বিভাগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে অনুষদে উন্নীত করে নতুন বিভাগ স্থাপন করে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের নাম পরিবর্তন করে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ নামকরণ করা হয়। ২০০৪ সালে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অধীনে ব্যাংকিং ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নামে আরও দুটি নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ২০০৭ ও ২০০৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস নামে আরো দুটি নতুন বিভাগ খোলা হয়। ২০০০ সাল থেকে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ব্যবসায় নির্বাহীদের জন্য সান্ধ্যকালীন এম.বি.এ প্রোগ্রাম প্রবর্তন পেশাগত ব্যবসায় শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

ব্যবসা খাতের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপক তৈরির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) প্রতিষ্ঠা করে এমবিএ কোর্স প্রবর্তন করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম শুরু হয়। এসময় শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আই.বি.এর কিছু সংখ্যক শিক্ষককে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অস্থানীয় শিল্পোদোক্তা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে ব্যবসায় দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব দেখা দেয়। এই অভাব পুরণ ও সামগ্রিকভাবে দেশের প্রয়োজনীয় চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ ব্যবস্থাপক তৈরির জন্য ব্যবস্থাপনা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ১৯৮৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সাহায্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কারিকুলাম উন্নয়ন, শিক্ষকদের বিদেশে প্রশিক্ষণ, গ্রন্থাগার উন্নয়ন, পরামর্শক নিয়োগ প্রভৃতি ছিল এ প্রোগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, আইবিএ ও ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের উন্নত দেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ব্যবসায় শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া কমনওয়েলথ, ফুলব্রাইট, রাশিয়া, ভারত, জাপান, বেলজিয়াম ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্র, বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্কলারশিপ প্রোগ্রামে আরো অনেক শিক্ষক বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ব্যবসায় শিক্ষায় নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ১৯৬৯ সালে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকও ছিল না, সেখানে বর্তমানে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকসহ ফ্যাকালটি সমৃদ্ধ।

ব্যবসা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নয়ন এর সাথে সাথে ব্যবসা শিক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তনও আনা হয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৯৪-১৯৯৫ শিক্ষাবর্ষে অনুষদের ডিগ্রির নাম বিকম (সম্মান) ও এমকম এর পরিবর্তে যথাক্রমে বিবিএ (সম্মান) ও এমবিএ করা হয়। বিবিএ (সম্মান) কোর্সের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয় চার বছর।

বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের আওতায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াও পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, গ্রন্থাগার উন্নয়ন, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং কিছু শিক্ষকের খন্ডকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আমেরিকার বিজনেস স্কুলের ব্যবসা শিক্ষার অধ্যাপক এবং স্থানীয় অধ্যাপকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বি.বি.এ পাঠ্যক্রমের পুনর্বিন্যাস, নতুন বিষয় সংযোজন করে পাঠ্যক্রমকে সময়োপযোগী করা হয়। এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামের পুনর্বিন্যাস করা হয়। পাঠ্যক্রমের পরিমার্জন ও উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ১৯৮৮ সালে উচ্চতর ব্যবসা শিক্ষা প্রোগ্রামের পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কিনা যাচাই এবং পাঠ্যক্রম উন্নয়নের জন্য অধ্যাপক ড. এএইচএম হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বেৎ একটি কমিটি গঠন করে উক্ত কমিটি বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বিজনেস স্কুলের পাঠ্যক্রমের আলোকে বাংলাদেশের প্রচলিত পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করেন, ব্যবস্থাপক ও শ্রম বাজারের চাহিদা চিহ্নিত করে পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করার কিছু মূল্যবান সুপারিশ করেন। সুপারিশের আলোকে পাঠ্যক্রমের উন্নয়ন করা হয়। বর্তমানে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ব্যাপকভিত্তিক নানা বিষয় পড়ানো হয়। এগুলি হচ্ছে ব্যবসায় যোগাযোগ স্ট্যাটিসটিকস্, ব্যবসায় গণিত, ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক অর্থনীতি, ব্যবসায় নীতি ও সংগঠন, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিপণন ব্যস্থাপনা, বিজনেস রিসার্চ হিসাব বিজ্ঞান, উৎপাদন ব্যয় ব্যবস্থাপনা, ইনটারন্যাশনাল বিজনেস, ব্যাংকিং ও বীমা, প্রকল্প মুল্যায়ন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, শিল্পোদ্যোগ, মাইক্রো ক্রেডিট, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিসটেম, ট্যুরিজম ও অতিথি সেবা, কম্পিউটার, ই-কমার্স ইত্যাদি। এছাড়া ইনটার্নশিপ প্রোগ্রাম, শিল্প কারখানা পরিদর্শন, শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে অন্তভূক্ত করা হয়। ফলপ্রসু ব্যবসা শিক্ষাদানের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা উপকরণ ও ব্যবহূত হচ্ছে। পাঠাগারে নতুন নতুন বই সংযোজন করা হয়েছে এবং বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জার্নাল আমদানি এবং কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।

বর্তমানে ব্যবসায় শিক্ষা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে যারা যোগ্যতার সাথে ব্যবসা ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন শাখার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবসা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রদের বিভিন্ন কলকারখানা পরিদর্শন প্রোগ্রাম, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের সাথে মত বিনিময়ের ফলে বাস্তব জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে সফল শিল্পোদ্যোক্তা, নির্বাহী বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তাদের অতিথি বক্তা হিসেবে শ্রেণি কক্ষে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় যার ফলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের মুখোমুখি মত বিনিময়ের সুযোগ পায়। তবে ব্যবসায় ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সহযোগিতার পরিধি এখনো সীমিত যা আরো বিস্তৃত হওয়া একান্ত আবশ্যক।

ব্যবসায় শিক্ষা একটি পেশাকেন্দ্রিক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাও বটে। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টেন্টস ও ইনস্টিটিউট অফ কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্টস পেশাকেন্দ্রিক দক্ষ হিসাববিদ তৈরি করছে। ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট এবং ব্যাংক প্রশিক্ষণ একাডেমী ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। বীমা কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স একাডেমী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট মধ্য পর্যায়ের সাধারণ ব্যবস্থাপকদের  প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোর্স প্রবর্তন করেছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড ভিত্তিমূলক শিক্ষা হিসাবে পাঠ্যক্রমে ব্যবসায় কোর্স অন্তর্ভূক্ত করেছে। ব্যবসায় পেশাভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে এসব প্রতিষ্ঠানের অবদান অপরিসীম।

ব্যবসা ও আর্থিক সমস্যাবলীর উপর গবেষণা পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের আওতায় ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বিজনেস স্টাডিজ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের গবেষণার পথ সুগম হয়। ইতিমধ্যে ব্যবসা ও অর্থনীতির চলতি সমস্যাসমূহের উপর বেশ কিছু গবেষণার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং এদের ফলাফল গবেষণা মনোগ্রাফ ও প্রকাশনা হিসেবে বিশেষায়িত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলছে। ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চ কর্তৃক প্রকাশিত কয়েকটি মনোগ্রাফ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গবেষকদের গবেষণার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চ মেথোডোলজির উপর  কোর্স পরিচালনা করে। ফলে দেশে সামগ্রিকভাবে বিজনেস শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশের প্রায় সব বড় কলেজেই ব্যবসা শিক্ষার স্মাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রোগ্রাম রয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, আধুনিক বই ও জার্নাল ও উন্নত গ্রন্থাগারের অভাব রয়েছে। গবেষণারও সুযোগ-সুবিধা নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এসব কলেজের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও কার্যক্রম তদারকি করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শিক্ষকদের জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে রিফ্রেশার্স কোর্সের আয়োজন করে। শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষা যথা এম.ফিল ও পি.এইচডি করারও সুযোগ রয়েছে যদিও এসব সুযোগ খুবই অপ্রতুল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সহায়তার মাধ্যমে শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রি লাভের প্রোগ্রাম আরো শক্তিশালী করা একান্ত প্রয়োজন।

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ১৯৯৬ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি সুদুর প্রসারী উদ্যোগ। বেসরকারি উদ্যোগে এযাবতকালে প্রতিষ্ঠিত ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটিতে ব্যবসায় শিক্ষা প্রদান একটি অন্যতম কর্মসূচি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যয়বহুল হলেও উচ্চবিত্তের এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ বঞ্চিতরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনার সুযোগ পায়। ব্যবসা শিক্ষার দ্রুত প্রসারের ফলে বিশেষ করে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব দারুণভাবে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক প্রণোদনা বেশি থাকায় দেশে ও বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত অনেক মেধাবী তরুণ গ্র্যাজুয়েট এ পেশায় যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অভাব পুরনার্থে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ঢাকা এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ এক অনন্য ভুমিকা রাখছে। এর ফলে একদিকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মত বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি অন্যদিকে শিক্ষাদান কৌশলেরও উন্নতি সাধিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া ব্যবসা শিক্ষা পদ্ধতির মান উন্নয়নে সহায়ক।

বাংলাদেশে বর্তমান প্রকট বেকার সমস্যার প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য দ্রুত শিল্পায়ন ও ব্যবসার উন্নয়ন আবশ্যক। গুণগত যোগ্যতাসম্পন্ন অধিক সংখ্যক দক্ষ ব্যবস্থাপক এবং শিল্পোদ্যোগক্তা সৃষ্টির জন্য আধুনিক ব্যবসা শিক্ষার বিকল্প নেই। বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তনের পেক্ষাপটে ব্যক্তিখাতের উন্নয়নের ফলে উচ্চ বেতনের নির্বাহী হিসেবে ব্যবসায় শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েটদের শ্রমের বাজার বেশ উজ্জল। এছাড়া চাকুরীর বিকল্প হিসেবে ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। পাঠ্যসূচিতে শিল্পোদ্যোগ কোর্স প্রবর্তনের ফলে এখন অনেক গ্র্যাজুয়েট ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিজের কর্মসংস্থান এবং তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। বর্তমান আধুনিক ব্যবসায় শিক্ষা দেশের শিল্পায়ন ও ব্যবসার ক্রমবর্ধমান দক্ষ ব্যবস্থাপকের চাহিদা মিটিয়ে চলছে। [এ.এইচ.এম হাবিবুর রহমান]