বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা অর্জনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে অনেক দেশে বহু আগে বিকাশ লাভ করলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একতরফা ভূমিকা ছিল। দক্ষ, কার্যকর ও যোগ্য জনশক্তিকে সংগঠিত করার জন্য উচ্চ শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ১৯৯২ সালে যুগোপযোগী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করা হয়েছিল। ১৯৯৩ সাল অবধি বেসরকারি খাতে যে ভালো মানের উচ্চশিক্ষা প্রদান করা সম্ভব তা হাতে গোনা মাত্র অল্প কিছু লোক বিশ্বাস করতেন। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে যথেষ্ট সক্ষম ছিল, তবুও তারা একটি টেকসই স্তর প্রতিষ্ঠা ও পৌঁছানো আগ পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে তারা প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। বেসরকারি খাতকে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব প্রদান ঝুঁকিপূর্ণ বলে অনেকের আশঙ্কা রয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সরকার অনুমোদিত প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের গ্র্যাজুয়েটরা পাস করার পর পরই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বেতনে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় এই আশঙ্কা অমূলক বলে প্রমাণিত হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখন শিক্ষার বর্ধিত চাহিদার চাহিদা মেটাতে দ্বিধা ও সমস্যায় পড়েছে।

যে সব কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ঘটেছিল সেগুলির মধ্যে দুটি কারণ প্রণিধানযোগ্য: (১) উচ্চশিক্ষার বর্ধিত চাহিদা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পক্ষে মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না, এবং (২) সরকারি তহবিলের অভাব অর্থাৎ দ্রুত বর্ধনশীল চাহিদা পূরণে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল, সরকারের পক্ষে বাজেটে তা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না হওয়া। এসব কারণ বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে সরকারের প্রচেষ্টার পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ আইনত উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ (১৯৯৮-এ সংশোধিত) পাস করে। এই আইনের আওতায় যে কোনো বেসরকারি ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এবং ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশনের মতো জনহিতৈষী সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে উল্লেখিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নিজস্ব অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও ডিগ্রি প্রদানের সুযোগ পেলেন। এ আইন পাস হওয়ার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে বেসরকারি খাতে বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিকল্প হিসাবে নয়, বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় উৎসাহিত হয়েছিল। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত সংখ্যা ও ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির মুখে প্রতিষ্ঠাতাদের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ও আর্থিক সম্পদ যথাসময়ে যোগান দিতে হিমসিম খেতে হয়েছিল। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দীর্ঘসময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুপযুক্ত পরিবেশে ভাড়া বাড়িতে ক্লাশ চালাতে হয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২-এ বেঁধে দেওয়া পাঁচ বছর সময়সীমার মধ্যে কেউই নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করতে পারে নি। এ ছাড়া শিক্ষক, সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাব, গ্রন্থাগার এবং শিক্ষা সহায়ক উপকরণসহ অন্যান্য সম্পদের তীব্র অভাব ছিল। অন্যান্য দেশে যেমনটি ঘটেছিল, তেমনি এ দেশেও ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে ওঠায় সম্ভবত শিক্ষার মান নিম্নগামী হয়েছিল। প্রায়ই এ ধরণের অভিযোগ চালু ছিল যে মূলত অর্থ রোজগারের লক্ষ্যে কিছু প্রতিষ্ঠাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছে। তারা ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে বেতনের টাকা সংগ্রহে লিপ্ত ছিলেন কিন্তু যোগ্য শিক্ষক সংগ্রহ করতেন না। শিক্ষার মান নয়, অর্থ রোজগারের বিষয়টি তাদের মূল আরাধ্য ছিল। তাই অনিবার্যভাবে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকবৃন্দ, সরকার এবং গোটা সমাজে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। নিম্নমানের ও শিক্ষা কার্যক্রম বিবর্জিত নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালনা বন্ধ করে একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ঘুরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ধারণা করা হয়েছিল যে, ১৯৯২ ও ১৯৯৮-এর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে মানের নিশ্চয়তা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সমাজসেবা ও সুশাসন-এর মতো বিষয়গুলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ফলশ্রুতিতে জাতীয় সংসদ ১৯৯২ সালের আইনটি বাতিল করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ পাস করে। সুশাসন ও উন্নততর ব্যবস্থাপনায় নিশ্চিত করার জন্য নতুন আইনে ট্রাস্টি বোর্ড, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কমিটি, কারিকুলাম কমিটি, অর্থ কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি ও শৃঙ্খলা কমিটির মতো কয়েকটি সংবিধিবদ্ধ কমিটি গঠনের ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শাস্তির বিধান সংযোজন করা হয়। এই সংবিধিবদ্ধ কমিটিগুলির গঠন, কার্যাবলী ও ক্ষমতা এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহের বিবরণ ২০১০ সালের আইনে বর্ণিত রয়েছে। এ সকল কমিটিতে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধিত্ব রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। নতুন আইনে ভাইস চ্যান্সেলরকে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী এবং একাডেমিক অফিসার করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং তিনিই বোর্ড অব ট্রাস্টির সুপারিশক্রমে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও ট্রেজারারকে নিয়োগ দেয়ার অধিকারী।

সরকারের পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও মনিটর করে থাকে। ইউজিসির সুপারিশক্রমেই সরকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দান করে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইউজিসি অনুমোদিত নিজস্ব কোনো কারিকুলামসহ সকল একাডেমিক ও ডিগ্রি প্রোগ্রাম অবশ্যই থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতাও এতে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিকট যে কোনো বিষয়ে তথ্য চাওয়ার অধিকারী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে উল্লেখিত আবশ্যকীয় শর্তাদি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা, তা নির্ধারণের জন্য ইউজিসি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে থাকে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র-বেতন ও অন্যান্য ফি এবং শিক্ষকদের সম্মানী কাঠামো নির্ধারণের স্বাধীনতা রয়েছে। আয় ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইউজিসি প্রণীত ছকে নিরীক্ষাকৃত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে দাখিল করতে হয়।

নতুন আইনে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুশাসন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও অনিয়ম প্রতিরোধের জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য এবং শিক্ষার মানের নিশ্চয়তা রক্ষার বিধান রয়েছে। অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, পিতামাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বছরে অন্ততঃপক্ষে একবার মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নতুন আইনে গুণগত নিশ্চয়তা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সমাজসেবা এবং সুশাসনের মতো বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নিয়ম-কানুন, সমন্বয় ও সহযোগিতার বৃহত্তর সুযোগ বিদ্যমান। এছাড়া, এই আইনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি স্বতন্ত্র অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল (এসি) গঠনের বিধান রয়েছে। ইউজিসির বিদ্যমান অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের ক্ষেত্র ও কর্মপরিধি থেকে এই কাউন্সিলের ক্ষেত্র ও কর্মপরিধি ভিন্ন। দুটি কাউন্সিল কার্যক্ষেত্রে অংশত একই দায়িত্ব পালন করলেও দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত। এসি সৃজনের উদ্দেশ্য হল, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টির অথবা পৃথকভাবে এর কোনো বিভাগ ও স্বতন্ত্র কোনো শিক্ষা কার্যক্রমের মান পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও প্রত্যায়ন করা। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল-এর কার্যক্রম সম্পর্কিত তথ্য ও ফলাফল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং জন সাধারণকে অবহিত করা হয়ে থাকে।

অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিষ্ঠাতাগণ তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু এ বিষয়ে ইউজিসি ও সরকারের অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির মতে নতুন আইনটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন, দি এ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ- যুক্তি দেখায় এই বলে যে, ২০১০ সালের আইনটিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির অযাচিত হস্তক্ষেপের যে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে তাতে নিরূৎসাহব্যঞ্জক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে সরকারের দাবি এই নতুন আইন সংশ্লিষ্ট সকল মহলের মধ্যে সমস্যা তৈরির সুযোগ কমিয়ে এনে শেষ অবধি সুশাসনের পথ সুগম করবে। শিক্ষক নিয়োগ, বাৎসরিক বাজেট অনুমোদন, তহবিল সংগ্রহ ও এর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, কৌশলগত পরিকল্পনা অনুমোদনের মতো প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে স্ট্রাস্টি বোর্ড ক্ষমতাবান হলেও এই সকল বিষয়ে নতুন আইনের আওতায় গঠিত বিভিন্ন কমিটির কার্যকর শিক্ষা সুশাসনের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

ছাত্র ও ছাত্রীদের আনুপাতিক হার (%)

২০১৯ সালে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে ৯৪টি সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল (৪৬তম ইউজিসি বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১৯)। ৪৬তম ইউজিসি বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সেশনে বেসরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে প্রায় ৩৪৯১৬০ এবং ৩৮৭৬১১৪ জন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৯ সেশনে, ৩৪৯১৬০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১৪৬১৫ জন মহিলা শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। সুতরাং, শতাংশের ভিত্তিতে পুরুষ ও মহিলা ছাত্রদের অনুপাত যথাক্রমে ৭১% এবং ২৯%। অধিকন্তু, ৪৬তম ইউজিসি রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সালে নথিভুক্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কম ছিল (৩,৬১,৭৯২) যা ৩.৪৯% নেতিবাচক বৃদ্ধির ইঙ্গিত করে। ২০১৬ সালে একই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছিল, যেখানে ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। যদিও এই হ্রাসের হার ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পূর্বের ১০ বছরের মতো উল্লেখযোগ্য নয়, সামগ্রিক ছাত্রবৃদ্ধি ছিল সন্তোষজনক। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ২০১৯ সালের সেশনে ২০৫৯৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বিপরীতে, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন, সেখানে তা ছিল মাত্র ৭৮ জন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে। এতে ডিগ্রি প্রোগ্রাম চার বছরে সম্পন্ন করতে হয়। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি বাজারে চাহিদা রয়েছে এমন সকল বিষয় উচ্চ ছাত্র বেতনের বিনিময়ে পড়িয়ে থাকে। প্রকৃত অর্থে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি প্রোগ্রামে শুধু ঐ সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে যে সকল শাস্ত্রের বাণিজ্যিক দর বেশ উচু। উচ্চ বেতনের চাকরি বা বেশি অর্থ আয়ের লক্ষ্যে আগেও এ সকল বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে তাই ক্যাম্পাস উন্নয়ন ফি-সহ বিভিন্ন রকম ফি এবং মোটা ছাত্র বেতন আদায় করা হয়ে থাকে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকে থাকার ক্ষেত্রে এর শিক্ষা কার্যক্রমসমূহ সাবধানতার সাথে নির্বাচন করা এবং ছাত্র বেতন ও অন্যান্য ফি কাঠামো নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ছাত্র-বেতন এবং আনুষঙ্গিক ফি এদের রাজস্ব আয়ের একমাত্র উৎস। এ যাবৎ কালের অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষণীয় যে ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকতর ভালো চাকরির নিশ্চয়তা রয়েছে এমন সম্ভাবনাময় বিষয়ে বা কোর্সে মূলত অধ্যায়ন করতে চায়। সুতরাং এমন সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে শিক্ষার্থী সর্বাধিক, এর পরের সংখ্যা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিষয়গুলিতে। দর্শন, সমাজতত্ত্ব, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মতো জ্ঞানভিত্তিক বিষয়ে ডিগ্রি প্রদানকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা খুবই কম।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে দ্রুত বিকাশমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভূমিকা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সূত্র ধরে উচ্চ শিক্ষার্থে শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার হার কমে আসছে। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা এভাবে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন। ভবিষ্যতে দেশে বিশ্বমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদার প্রসার ঘটবে। উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান জাতীয় চাহিদা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বাদ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অবশ্যই পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে সহাবস্থান করে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির পরিমাণ এক নয়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যয়বহুল, অন্যগুলির ব্যয় কম। এই বিষয়টি নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং সেখানকার অবকাঠামো, শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক স্থাপনা ও যন্ত্রপাতিসহ শিক্ষা উপকরণের উপর। ভালমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চাইতে অনেক ব্যয়বহুল। অর্থাৎ সচ্ছল ও ধনী পরিবারের সন্তানেরাই কেবল এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে সমর্থ হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্থান নেই এমন একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। অভিযোগটি অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে প্রতিষ্ঠাতাগণ মোট রেজিস্টার্ড শিক্ষার্থীর শতকরা কমপক্ষে ছয়ভাগকে মেধাবী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিবেচনায় বিনাবেতনে অধ্যায়নের অনুমতি দিতে পারেন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এই বিধানটি প্রতিপালন করে থাকে।

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ঘন ঘন তাদের উন্নত শিক্ষা প্রদানের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে খুব কম সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় মান বজায় রাখতে পারে। বহু কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হচ্ছে: ১২ বছর স্কুল-কলেজে পড়ার পর বেশিরভাগ মেধাবী শিক্ষার্থী অপেক্ষাকৃত খ্যাতনামা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হতে চায়। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত ভালো, তারা উৎকৃষ্ট মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অবশিষ্ট অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের স্থান হয় নিম্নমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। এই নিম্নমানের ছাত্র-ছাত্রীদের সৃষ্ট সমস্যার ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মানের সঙ্কট থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই ন্যূনতম মান বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় সম্পদ সংগ্রহে সদা সচেষ্ট থাকলেও তারা ভালো শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এতে পরিণতি আরো খারাপ হয়।

তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্ষুণœ হওয়ার বিশেষ কারণ এই শিক্ষক সংকট। অধিকন্তু, অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার চাপ (প্রতি সেমিস্টারে ৩ থেকে ৪টি কোর্সের মধ্যে) ও বাধ্যতামূলক অফিস সময়ের কারণে বেশিরভাগ সময় সংশ্লিষ্ট অনুষদগুলিতে শিক্ষকগণ গবেষণা পরিচালনা বা ভালমানের জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশ করার জন্য খুব কম সময় পায়। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে চাকরির নিরাপত্তার অভাবে প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার অনুভূতি সৃষ্টি হয় না। তবে শুধুমাত্র শিক্ষক সংকটের ফলে এ পরিস্থিতি উদ্ভূত হয় নি, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ফলেও এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। নিষ্প্রভ ভাবমূর্তির সংকটে নিপতিত এসব বিশ্ববিদ্যালয় দুষ্টচক্রের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সংখ্যায় আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা নিম্নমানের অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করছে। বাংলাদেশে এ বিষয়টি নতুন নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে অতি উঁচু বা বিশ্বমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নিম্নমানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলি নিজেদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে ধরে রাখতে সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে প্রতিষ্ঠাতাদের এ ধরনের উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করার সাথে সাথে নিম্নমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংখ্যা হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। [হাফিজ জিএ সিদ্দিকী]