বেথুন সোসাইটি
বেথুন সোসাইটি (প্রতিষ্ঠা ১৮৫১) একদিকে বাঙালিদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানানুশীলনের উৎসাহ বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে ইউরোপীয় ও স্থানীয় জনগণের বর্ণগত পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্বৎ সংগঠন। উদারমনা কিছু ইউরোপীয় এবং কতিপয় জ্ঞানদীপ্ত স্থানীয় ব্যক্তির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ সোসাইটির নামকরণ হয় গভর্নর জেনারেলের পরিষদের আইন উপদেষ্টা এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের (১৮০১-১৮৫১) নামে। তিনি তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মতৎপরতার জন্য সমকালীন সমাজে সুপরিচিত ছিলেন। আইনের দৃষ্টিতে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের সমমর্যাদা দিয়ে বেথুন একটি বিলের খসড়া প্রস্ত্তত করেছিলেন। শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি অনেক স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাঙালিদের বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। এমনকি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার চর্চা জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে তিনি একটি স্বর্ণপদক প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, মধুসূদন দত্ত যখন ইংরেজি সাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিলেন, তখন বেথুন তাঁকে প্রভাবিত করেন যেন তিনি ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। একজন মানবতাবাদী এবং ভারতীয় স্বার্থের প্রকৃত প্রবক্তা বেথুনের ১৮৫১ সালের ১২ আগস্ট অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর স্মরণে কলকাতার বিদ্বৎ সমাজ এ সমিতি প্রতিষ্ঠা করে এর নামকরণ করেন ’বেথুন সোসাইটি’।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের অধ্যাপক এবং বেথুনের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী এফ.জে মোয়াট ছিলেন এ সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা। ১৮৫১ সালের ১১ ডিসেম্বর মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সভায় সমিতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির ন্যায় গুরুগম্ভীর নয়, আবার আশপাশের বহু সমিতির মতো মামুলি ধরনেরও নয়, এমন একটি সংগঠন কিভাবে দেশের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য প্রয়োজন তা মোয়াট এ সভায় ব্যাখ্যা করেন। সভায় উপস্থিত সদস্যগণ মোয়াটের প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন এবং কেবল সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশ্নের আলোচনা ও অনুসন্ধানের জন্য একটি অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। মোয়াট সমিতির কর্মকান্ডের এক বছরের যাবতীয় ব্যয় নিজেই বহন করার প্রস্তাব দেন। সোসাইটির প্রথম কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন: এফ.জে মোয়াট (সভাপতি), রামগোপাল ঘোষ ও রেভারেন্ড জেমস লং (সহ-সভাপতি), প্যারীচাঁদ মিত্র (সাধারণ সম্পাদক), সদস্যবৃন্দ ছিলেন মেজর জি. টি মার্শাল, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বেথুন সোসাইটি চল্লিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই সময়ে সোসাইটি এর কর্মকান্ডে স্থানীয় ও ইউরোপীয় অনেক বুদ্ধিজীবীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। মাত্র ২১ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে ১৮৬০ সালে এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫০-এ। এ সময়ে সোসাইটির প্রকাশনায় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বহু বাঙালি পন্ডিতের লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামচন্দ্র মিত্র, হরমোহন চট্টোপাধ্যায়, রাধানাথ সিকদার, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, নবীনকৃষ্ণ বসু প্রমুখ। দীর্ঘকাল স্থায়ী না হলেও বেথুন সোসাইটি এর লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয়। এটি বাঙালিদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ এবং ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সমঝোতা ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। রীতিমাফিক সমিতির সভাপতি ছিলেন একজন ইউরোপীয় এবং সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ভারতীয়। সোসাইটির মাসিক সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার অনেকগুলিই পরবর্তী সময়ে প্রবন্ধ হিসেবে বা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এসব রচনা বিশেষত স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলি এতই তথ্যসমৃদ্ধ ও কালোত্তীর্ণ যে, অদ্যাবধি এগুলি রেফারেন্স হিসেবে উল্লিখিত হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মোকাবিলায় অনেক সদস্যই প্রচেষ্টা চালিয়েছেন স্থানীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ইউরোপীয়দের গোচরীভূত করার। অতীত সন্ধানের কাজে এগুলি এখন মূল্যবান তথ্য হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। [সিরাজুল ইসলাম]