বিশেষ ট্রাইব্যুনাল

বিশেষ ট্রাইব্যুনাল  কোন নির্দিষ্ট বিষয় অথবা বিবাদের তদন্ত করে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত একটি বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। যদি এই ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত হয়, এবং প্রশাসনিক ও নির্বাহী কার্যাবলী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিচারবিভাগীয় কাজের দায়িত্ব একে প্রদান করা হয়, তাহলে এর আওতাধীন বিচারকার্য পরিচালনাকারী সকল প্রতিষ্ঠানই এর কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ‘আদালত’ বলতে ব্যবহারিক অর্থে যা বুঝায় তা হলো রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত একটি ট্রাইব্যুনাল সাধারণ ক্রমভিত্তিক আদালতের অংশবিশেষ এবং যাকে রাষ্ট্রের স্বভাবজাত  বিচার কার্যের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ট্রাইব্যুনাল আদালত থেকে স্বতন্ত্র, কারণ বিচারবিভাগীয় অথবা আধা-বিচারবিভাগীয় যে সকল বিষয় ট্রাইব্যুনালের নিকট উত্থাপন করা হয় ট্রাইব্যুনাল সে সম্পর্কে বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিন্তু প্রায়োগিক অর্থে কোন আদালত গঠন করে না। ট্রাইব্যুনাল কোন সাক্ষীকে উপস্থিত হতে বাধ্য করতে পারে, শপথ বাক্য পাঠ করাতে পারে এবং তাকে কিছু কার্য-প্রণালী বিধি অনুসরণ করে চলতে হয়। সাক্ষ্য গ্রহণের কড়াকড়ি ও প্রায়োগিক বিধিমালা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ট্রাইব্যুনালের নেই, তাহলেও যে সাক্ষ্য প্রমাণ এর সম্মুখে উপস্থাপন করা হয়, তার উপর ভিত্তি করেই তাদেরকে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হয়। যদিও ট্রাইব্যুনালের পক্ষে আইনের অন্যান্য ব্যবহারিক বিধিমালা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু এর সিদ্ধান্তবলী আইনের সাধারণ নীতিমালার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হয়। অন্য কথায় বলা যায়, ট্রাইব্যুনালকে ন্যায় বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কাজ করতে হয় এবং বস্ত্তনিষ্ঠভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। শুধু প্রশাসনিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ট্রাইব্যুনাল এগুতে পারবে না আবার ব্যক্তিনিষ্ঠ পছন্দ বা ব্যক্তিগত অভিলাষের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত প্রদান করা যাবে না। যে সকল পদ্ধতিগত বিধি ট্রাইব্যুনালগুলির কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের নিকট উত্থাপিত বিষয়বলীর বিচার পরিচালনায় ক্ষমতা প্রদান করে, তা কোন কোন সময় আদালতের ব্যবহূত প্রতীক অলঙ্কার বলে অভিহিত করা হয়। তাই কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ ট্রাইব্যুনাল কি না তা নির্ণয় করতে হলে মোটামুটিভাবে দেখা হয় যে উক্ত প্রতিষ্ঠান আদালতে ব্যবহূত প্রতীক অলঙ্কার দ্বারা আচ্ছাদিত কি না।

ট্রাইব্যুনাল এবং আদালত উভয়ই বিচারকার্য পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এবং এগুলি তাদের এখতিয়ারে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বিভিন্ন জনগণের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদসমূহ পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখে এবং চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আদালতকে তাদের কার্য পরিচালনা এবং ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে  যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় তা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে এবং আদালতকে সেসব পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। ট্রাইব্যুনালগুলোকে যে সকল পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতে হয় সেগুলো হয়তো সব সময় তেমন কড়াকড়িভাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় না। তবে আদালত ও ট্রাইব্যুনাল উভয়কে যে মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হয় তা মূলতঃ এক এবং তারা  যে কাজ সম্পাদন করে তার মধ্যে প্রভেদ খুব সামান্য। আদালতের ক্ষেত্রে যা ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রেও তাই, অর্থাৎ এটা রাষ্ট্রের সহজাত বিচার ব্যবস্থার ক্ষমতা এবং উক্ত হস্তান্তরিত ক্ষমতাবলে বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করে। বিচার কার্য ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা একটি সাবভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে একান্ত আবশ্যকীয় উপাদান। নীতিকুশলতা বিবেচনা করে রাষ্ট্র তার বিচারকার্য এবং বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা প্রধানত সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত আদালতসমূহের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু বিশেষ ধরনের বিষয় এবং বিভিন্ন জনগণের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদের বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে ট্রাইব্যুনালকে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা ও বিচারবিভাগীয় যে আংশিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা কোনক্রমে খর্ব হয় না। আদালত ও ট্রাইব্যুনালের মধ্যে ভিত্তিগত ও মৌলিক মিল এখানেই যে তারা উভয়েই বিচার কার্য পরিচালনা করে এবং বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে। তবে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় ভিন্ন আইন দ্বারা এবং তা দেওয়ানি বা ফৌজদারি কার্যবিধি দ্বারা অনুমোদিত নিয়মিত ক্রমভিত্তিক আদালত থেকে পৃথক। ব্যতিক্রম হচ্ছে এটা উচ্চবিচার বিভাগ এবং এর ক্ষমতা সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত।

গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মধ্যে পাকিস্তান আমলের ১৯৬৪ সালের ৫ নং অধ্যাদেশ সম্পর্কিত ট্রাইব্যুনাল উল্লেখযোগ্য। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা করা। এই সব অপরাধ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত। কোন কর্মকর্তা, সৈনিক, নৌবাহিনীর নাবিক, বিমানবাহিনীর সদস্য কর্তৃক বিদ্রোহ ঘটানোর কাজে সহায়তা করা অথবা কোন কর্মকর্তা, সৈনিক, নাবিক বা এয়ারম্যানকে তার আনুগত্য অথবা কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত রাখার অপপ্রচেষ্টা। অবশ্য দন্ডবিধিতে এই সব অপরাধের শাস্তির বিধান ছিল। তবুও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই সব অপরাধের বিচারকার্যের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনকল্পে এই অধ্যাদেশ জারির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এর ফলে এ সব অপরাধ নিয়মিত আদালতের আওতা বহির্ভূত রাখা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচারের জন্য বস্ত্ততঃ একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল যা প্রসিদ্ধ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এর বিরুদ্ধে সমগ্র দেশব্যাপী প্রতিবাদের ফলে যে অধ্যাদেশের বলে ট্রাইব্যুনালটি গঠিত হয়েছিল তা কয়েক মাস চলার পর ১৯৬৯ সনে রহিত হয়ে যায়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান যখন ১৯৭২ সালে গৃহীত হয়, তখন এতে ট্রাইব্যুনালের কোন উল্লেখ ছিল না। সংবিধান মোতাবেক হাইকোর্ট ডিভিশনের উপর তার অধীনস্থ সকল আদালতের দেখাশুনা ও তত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। পরে সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯১ কতৃক আদালত শব্দটির পর ট্রাইব্যুনাল শব্দটি সন্নিবেশ করা হয়।

অন্যান্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গুলি ১৯৬০ সালে গঠিত হয়। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭ মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধের বিচার ততরান্বিত করার উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৬০-এ রয়েছে। অবশ্য প্রাসঙ্গিক আইনে বিশেষ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এতে সাধাসণভাবে এই কথা বলা হয়েছে যে, দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭-এ সংজ্ঞায়িত অপরাধসমূহের বিচার পরিচালনার কাজে একচেটিয়া কর্তৃত্ব দিয়ে এই সব ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে। এতে আরও বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক দায়রা জজ তাঁর রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারসীমার মধ্যে ট্রাইব্যুনাল হিসাবে কাজ করতে পারবেন।

বিশেষ ধরনের অপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের আইনের আর একটি দৃষ্টান্ত ২০০০ সালের আইন-৭। এটি হচ্ছে জননিরাপত্তা আইন-২। এই আইনের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন করা। বেআইনীভাবে ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ আদায়, টেন্ডার প্রদানে টেন্ডারদাতাকে হুমকি দিয়ে বাধাপ্রদান করা, গাড়িঘোড়া ভাংচুর করা, অথবা অন্যান্য সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করা, রাস্তায় চলাচলে বাধাপ্রদান করা, মুক্তিপণ আদায় করা প্রভৃতি এই অপরাধের আওতায় পড়ে। এই আইনের আওতাধীন অপরাধসমূহ বিচারের জন্য সরকার মেট্রোপলিটন এলাকাসহ এক বা একাধিক জেলার জন্য ট্রাইব্যুনাল নিয়োগ করতে পারেন। জেলা ও দায়রা জজের সমমর্যাদার একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এই ট্রাইব্যুনালের প্রধান হিসাবে কাজ করবেন। প্রয়োজন দেখা দিলে সরকার একজন জেলা ও দায়রা জজকে তাঁর নিজস্ব দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে ট্রাইব্যুনালের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োগ করতে পারেন।

বিচার বিভাগীয় প্রশাসন বিশেষ করে উচ্চ বিচার বিভাগীয় প্রশাসনের রূপরেখা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে দেওয়া আছে। সংবিধানে বিশেষ আদালতের কোন উল্লেখ নেই। যাহোক, এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাইকোর্ট ডিভিশন তার অধীনস্থ সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করবে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ট্রাইব্যুনাল শব্দটি ছিল না। ১৯৯১ সালের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন)-এ এই শব্দটি সন্নিবেশ করা হয়। বিশেষ বিশেষ অপরাধ নিস্পত্তির জন্য বিভিন্ন আইনের অধীন ট্রাইব্যুনাল অথবা বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে বিশেষ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মধ্যে পার্থক্যটি খুব স্পষ্ট নয়। উভয় প্রকার আদালতকে আইনে সংজ্ঞায়িত অপরাধের বিচার করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনের অধীন ক্ষমতা প্রদান করা হয়। যাহোক, কার্যতঃ অপরাধের গুরুত্বের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এই পার্থক্য করা হয়। যেখানে অপরাধ সাংঘাতিক ও গুরুতর ধরনের সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল শব্দ ব্যবহার করা হয় এবং তা জেলা ও দায়রা জজ বা সমপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনার প্রয়োজন হয়। বিশেষ আদালতের ক্ষেত্রে এই বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হাকিমের নেতৃত্বে এই বিচারকার্য পরিচালনা করা যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিশেষ আদালতের বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কিত অপরাধের দ্রুত বিচার সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ খাদ্য (বিশেষ আদালত) আইন ১৯৫৬ (১৯৫৬ সালে আইন ১০)-এ আদালত গঠনের বিধান রয়েছে। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বিশেষ হাকিমরা এ আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধের বিচারকার্য পরিচালনা করেন।

অনুরূপভাবে, অভিবাসন অধ্যাদেশ ১৯৮২ (১৯৮২ সালের ২৯ অধ্যাদেশ) এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার এই আইনে গঠিত বিশেষ আদালত করতে পারে।

অপরপক্ষে, এমন ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টান্ত আছে যা সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচারকার্য স্বতন্ত্র আইনে পরিচালনা করে। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৬০ এরূপ একটি অধ্যাদেশ যাতে ১৯৫৭ সালের বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধের দ্রুত বিচার সম্পাদনের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে। তবে এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের আইনে বিশেষ শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। এতে সাধারণভাবে এই কথা বলা হয় যে, বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭-তে সংজ্ঞায়িত অপরাধসমূহ বিচারের কাজে একচেটিয়া কর্তৃত্ব দিয়ে এই সকল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। [এ.এম.এম শওকত আলী]