বিনিময় বিল

বিনিময় বিল (Bill of exchange)  প্রাপককে অথবা তার নির্দেশানুযায়ী নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বা বাহককে লিখিত পরিমাণ অর্থ প্রদানের জন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রদানকারীর লিখিত নির্দেশসম্বলিত শর্তহীন হস্তান্তরযোগ্য দলিল। বাংলাদেশে হুন্ডি বা বিনিময় বিল প্রমিসরি নোটস (অঙ্গীকার চিঠা) ও চেকের মতো হস্তান্তরযোগ্য দলিল ১৮৮২ সালের ১ মার্চ থেকে কার্যকর হস্তান্তরযোগ্য আইন ১৮৮১ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

বিনিময় বিলের পক্ষসমূহ হচ্ছে ড্রয়ার (আদেষ্টা), ড্রয়ি (আদিষ্ট), এক্সেপ্টর (স্বীকৃতিদাতা গ্রাহক), পেয়ি (প্রাপক), হোল্ডার (ধারক), ইনডোর্সার (অনুমোদনকারী), ইনডোর্সি (অনুমোদনবলে প্রাপক), ড্রয়ি ইন কেস অব নিড (প্রয়োজনবোধে আদিষ্ট), এবং এক্সেপ্টর ফর অনার (সম্মানার্থে স্বীকৃতিদাতা)। এই পক্ষসমূহ ছাড়াও ড্রয়ার বা ব্রিটিশ আইনমতে, রেফারেন্স ইন কেস অব নিড বিলের স্বীকৃতি না দেওয়া বা বিলের অর্থ প্রদান না করা থেকে (আদিষ্টকে) প্রাপককে রক্ষা করার জন্য ড্রয়ার (আদেষ্টা) অথবা সত্যায়নকারী কোন ব্যক্তির নাম প্রয়োজনবোধে আদিষ্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ করতে পারেন। কাগজি মুদ্রা বা ধাতব মুদ্রায় নগদে অর্থ প্রেরণ বা স্থানান্তর না করে অতীতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের দেনা এই বিনিময় বিলের মাধ্যমে প্রদান করা হতো। দেশি বিনিময় বিলের মতো প্রস্ত্তত না করে বৈদেশিক বিনিময় বিল প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিল অব এক্সচেঞ্জ নামে তিন প্রস্থে তৈরি করা হয়ে থাকে। তিনটির যে কোন একটির ওপর বিল পরিশোধিত হলে অপর দুটি পরিশোধের অযোগ্য হয়ে যায়। বৈদেশিক বিনিময় বিল পরিশোধে অস্বীকৃতি জানালে বা অসম্মান করা হলে তার জন্য অবশ্যই আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদপত্র পাঠাতে হয় এবং এই প্রতিবাদপত্র বিনিময় বিলের উৎস দেশের আইন অনুসারে প্রস্ত্তত করতে হয়।

সাধারণ প্রক্রিয়ায় কোন বিনিময় বিল অসম্মান করা হলে তার বাহক আদেষ্টাকে এবং নিকটতম সত্যায়নকারীকে নোটিশ প্রদান করেন। ১৮৮১ সালের হস্তান্তর দলিল আইনের ৬১ থেকে ৮২ ধারায় কোন কোন অবস্থায় বিনিময় বিল অসম্মান করা যেতে পারে এবং তার ফলাফল কী হতে পারে তা বর্ণনা করা হয়েছে। স্বীকৃতির তারিখ থেকে বৈদেশিক বিনিময় বিলের মেয়াদ হিসাব করা হয়ে থাকে। সুবিধাজনক ধরনে কোন বন্ধুকে অর্থ প্রদানের জন্য প্রস্ত্তত বিনিময় বিলকে উপযোজক বিল বলা হয়। কোন ব্যাংক কর্তৃক অন্যকোন ব্যাংক অথবা ঐ ব্যাংকের অন্যকোন শাখার অনুকূলে প্রদত্ত ডিমান্ড ড্রাফট বিনিময় বিল হিসেবে গণ্য। কিন্তু চেককে বিনিময় বিল বলা যায় না, কারণ এতে টাকা প্রদানের জন্য শর্তহীন কোন আদেশ থাকে না এবং তাতে স্বাক্ষর করে স্বীকৃতি দেওয়ারও প্রয়োজন হয় না।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাজে অর্থ যোগানোর জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজে এখন বিনিময় বিল ব্যবহূত হচ্ছে। যখন কোন ঋণগ্রহীতা কোন ব্যাংকের ওপর বিল প্রদান করে এবং ব্যাংক তা গ্রহণ করে, তখন ঋণগ্রহীতা এই বিল কোন বিনিয়োগকারীর নিকট বিক্রয় করতে পারে। মেয়াদ পূর্ণ হলে ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগকারীর অর্থ পরিশোধ করে। বিনিময় বিল নিয়ে কারবার করার জন্য বাজারে কর্মরত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আছে এক্সেপ্ট্যান্স হাউস, ব্রোকার ও ডিসকাউন্ট হাউস। স্বীকৃতির জন্য বিনিময় বিল আদিষ্টের নিকট উপস্থাপন করতে হয়। আদিষ্ট বিলের গায়ে স্বাক্ষর করে তার স্বীকৃতি দিয়ে থকেন। বিলের আদেষ্টা, স্বীকৃতিদাতা অথবা আদিষ্ট মারা গেলে তাদের বৈধ প্রতিনিধির নিকট তা উপস্থাপন করতে হয়। সাধারণত প্রস্ত্ততের তারিখের পর থেকে তিন মাসের জন্য বিনিময় বিল প্রদান করা হয় এবং তিন মাস তিন দিনের মধ্যে তা পরিশোধযোগ্য।

১৮৮১ সালে হস্তান্তর দলিল আইন পাশ হওয়ার বহুকাল আগে থেকে ব্রিটিশ ভারতে হুন্ডি নামে এক প্রকার স্থানীয় বিনিময় বিল প্রচলিত ছিল। সাধারণত হুন্ডি দেশীয় ভাষায় লিখিত হতো এবং সে যুগের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রথা ও রীতিনীতি অনুসরণ করে নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু দেশীয় এই বিনিময় বিল ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পৃক্ত দেনা পরিশোধ করার জন্য এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আদায়কৃত রাজস্ব ব্রিটিশ কোষাগারে স্থানান্তর বা প্রেরণের উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে হুন্ডি ব্যবহার করা হয়। ভারতে দর্শনি হুন্ডি, মুদ্দতি বা মেয়াদি হুন্ডি, শাহ যোগ হুন্ডি, নাম যোগ হুন্ডি, ধানি যোগ হুন্ডি, জখমি হুন্ডি, জওয়াবি হুন্ডি, জিকরি চিট, পুর্জা এবং ফরমান যোগ হুন্ডি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের হুন্ডির প্রচলন ছিল।

বর্তমানে প্যারিসে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স কর্তৃক জারীকৃত দলিলি ঋণের সমজাতীয় প্রথা ও রীতিসমূহ (Uniform Customs and Practice of Documentary Credits UCPDC) অনুসরণ করে বিনিময় বিল-সংক্রান্ত কার্যাদি পরিচালিত হয়ে থাকে।  [আবুল কালাম আজাদ]