বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ

বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শুরু থেকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার বিতর্ক শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে প্রণীত রেগুলেশন ৩-এর মাধ্যমে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কালেক্টরের বিচার করার ক্ষমতা রহিত করেন। এর ফলে দেওয়ানি আদালতের বিচারক জজ-ম্যাজিস্ট্রেট নামে অভিহিত হন। জেলা পর্যায়ে এ দুই বিভাগকে পৃথকীকরণের বিষয়টি ১৮২৮ সাল পর্যন্ত বহুল বিতর্কিত ছিল। লর্ড ওয়েলেসলি পৃথকীকরণের বিষয়টি সমর্থন করেন, কারণ এটি ব্রিটিশ সংবিধানের নীতির সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। ওয়েলেসলি পৃথকীকরণের পদক্ষেপ অন্যান্য প্রদেশে যেমন মাদ্রাজে চালু করতে গিয়ে মুনরো কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন। মুনরোর মতে সম্পূর্ণ বিষয়টিই ছিল কৃত্রিম ও বহিরাগত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৪ সাল থেকে বাংলার সরকারকে পৃথকীকরণের নীতি বর্জন করে জেলা পর্যায়ে বিচার ও নির্বাহী ক্ষমতা একীভূত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। লর্ড হেস্টিংসের সরকার ১৮২১ সালের ৪ নং রেগুলেশনের মাধ্যমে কালেক্টর ও অপরাপর রাজস্ব কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার প্রদানের জন্য গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে ক্ষমতা প্রদান করে। ১৮২৯ সাল নাগাদ কালেক্টর ও অন্যান্য রাজস্ব কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদানের কাজটি সম্পন্ন হয়। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিষয়ে বিতর্ক পুনরায় শুরু হয় এবং ১৯২১ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ১৮৫৩ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সময়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিষয়ে চারটি রিপোর্ট তৈরি হয়। প্রথম প্রতিবেদন সম্পন্ন হয় ১৮৯৩ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯০০ সালে এবং তৃতীয়টি ১৯০৮ সালে। সর্বশেষ চতুর্থ প্রতিবেদন পাওয়া যায় ১৯১৩ সালে। এ চারটি প্রতিবেদন প্রণীত হলেও ইতোপূর্বে সম্পাদিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত বিচার কাঠামোতে ১৯২১ সাল পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন করা হয় নি। ভারতে বিচার প্রশাসনের সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখার জন্য ভারতসচিব ১৯১২ সালে ইসলিংটন কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১৯১৫ সালের ১৪ আগস্ট যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে কর্মকর্তাদের নির্বাহী ও বিচার কার্যক্রম পৃথকীকরণের জন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। ১৯২১ সালের ৫ এপ্রিল বিধানসভায় নিম্নরূপ একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়: ‘বিধানসভা সরকারের নিকট সুপারিশ করছে যে, এই প্রেসিডেন্সিতে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য সরকার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’

পৃথকীকরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিস্তারিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য হাইকোর্টের একজন বিচারকের নেতৃত্বে বঙ্গীয় সরকার একটি কমিটি গঠন করে। ১৯২২ সালে কমিটি এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন পেশ করে। তবে অজ্ঞাত কারণে এ বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়।

তদানীন্তন পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত মূলনীতির অংশে বাস্তবসম্মত ভিত্তিতে বিচারবিভাগ পৃথকীকরণের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সংবিধানে এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ফৌজদারি কার্যবিধিমালা (পূর্ব পাকিস্তান সংশোধনী) বিল, ১৯৫৭ শীর্ষক বিলটি পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় পেশ করে। বিলটি যথারীতি আইনসভায় পাশ হয় এবং গভর্নরের অনুমোদনের পর ১৯৫৭ সালের ১১ নভেম্বর বিলটি আইনে পরিণত হয়। বিলটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা অংশে বলা হয়েছিল যে, পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। আইনে বলা হয়েছে যে, সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনটির প্রয়োগ সাধন করবে। কিন্তু প্রশাসনিক শাখার কর্মকর্তাদের প্রতিরোধের কারণে ঐ ধরনের কোনো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমেও আইনটির বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি।

পাকিস্তানে ১৯৬২ সালের সংবিধানে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কোনো উল্লেখই ছিল না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্য কিছু অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়। এর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়োগ করা হবে। জেলা জজদের সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে এবং অন্যান্যদের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে নিয়োগ দেয়া হবে। সংবিধানে এ ছাড়া বলা ছিল যে, ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি অনুমোদনসহ শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়াবলি সুপ্রিম কোর্টে ন্যস্ত করা হবে। এ ছাড়াও ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ ধারায় বলা হয়েছিল: ‘রাষ্ট্র নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করবে’।

নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সংক্রান্ত চলমান বিতর্কের অবসান ঘটে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাজদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে (৫২ ডিএল আর ২০০০)। বস্ত্তত এ রায়ে ঘোষণা করা হয় যে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিচার) সদস্য হিসেবে গণ্য না করে এদের একটি পৃথক সার্ভিস হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদেরও প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে পৃথক করতে হবে। এই নবগঠিত সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগ, বেতনক্রম, বদলি ইত্যাদি নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে; এসব ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টে ন্যস্ত করতে হবে। উপর্যুক্ত বিষয়াবলি বাস্তবায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্ট আরও তিনটি নির্দেশ প্রদান করে; একটি হলো পৃথক জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন এবং বেতন কমিশন গঠনসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন।

সিভিল সার্ভিসের প্রশাসনিক শাখার প্রবল বিরোধিতার কারণে দুটি রাজনৈতিক সরকার আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে নি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের লক্ষ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০০৭ জারি করে (২০০৯ সালে আইনে পরিণত)। এই অধ্যাদেশে (বর্তমানে আইন) রয়েছে দু’ধরনের ম্যাজিস্ট্রেট: বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব বিচারিক কার্য সম্পাদন এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব হলো নির্বাহী কার্য সম্পাদন। এই অধ্যাদেশ জারী ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন রুলস এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস পে কমিশন রুলস পুনর্বিন্যাস করে এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ও জুডিশিয়াল সার্ভিস পে কমিশন পুনর্গঠন করে। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুডিশিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, প্রাথমিক পদে নিয়োগ, সাময়িক বরখাস্ত, বরখাস্ত ও অপসারণ) রুলস এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস (পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও চাকরির অপরাপর শর্তাবলী) রুলস পুনর্বিন্যাস করে। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধি কার্যকর করা হয়। তখন থেকে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচারিক দায়িত্ব এবং সিভিল সার্ভিসের প্রশাসনিক বিভাগের কর্মকর্তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নির্বাহী ও প্রশাসনিক দায়িত্ব যথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, শান্তিভঙ্গ জনিত কার্যক্রম ও অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধ, লাইসেন্স প্রদান এবং মুলতবি ও বাতিল করণ, ফৌজদারিতে সোপর্দ বা অব্যাহতি দান প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ ছাড়াও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষমতাবলে তারা কতিপয় আইন ভঙ্গের জন্য অপরাধীকে জরিমানা করতে পারেন এবং জরিমানার অর্থ অনাদায়ে সীমিত কারাদন্ড দিতে পারেন। বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ফলে ইতোপূর্বে প্রশাসনিক বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটদের আদালতে ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির তুলনায় বর্তমানে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের আদালতে মামলার নিষ্পত্তি কার্যক্রম দ্রুততর হয়েছে, এবং পূর্বের তুলনায় এখন নাগরিক স্বাধীনতা আরো বেশি নিরাপদ হয়েছে।  [এ.এম.এম শওকত আলী]

গ্রন্থপঞ্জি 52 DLR (2000); A M M Shawkat Ali, Aspects of Public Administration in Bangladesh, Nikhil Prokashon, Dhaka, 1993, pp. 96-110, 1504; Justice K E Hoque, Administration of Justice in Bangladesh, Dhaka, 2012, pp. 53-55; Code of Criminal Procedure (Amendent) Act, 2004.