বাহারিস্তান-ই-গায়েবী

বাহারিস্তান-ই-গায়েবী বাংলার মুগল সেনাপতি আলাউদ্দীন ইসফাহান ওরফে মির্জা নাথান রচিত একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য এক অতি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। দরবারি ঐতিহাসিক দ্বারা লিখিত মুগল সাম্রাজ্যের অন্য সব গতানুগতিক ইতিহাস থেকে বাহারিস্তান-ই-গায়েবী ছিল ভিন্নধর্মী। সমগ্র সাম্রাজ্য অন্তর্ভুক্ত না করে লেখক শুধু বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঘটনাবলি নিয়ে গ্রন্থটি রচনা করেন।

বাহারিস্তানের লেখক মির্জা নাথানকে সম্রাট জাহাঙ্গীর শিতাব খান  উপাধি দেন। তিনি তাঁর সামরিক জীবন বাংলায় কাটান। অনেক ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেন এবং ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেসবের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি গায়েবী (অদৃশ্য) বা ছদ্মনাম (তাখুলুস) গ্রহণ করেন এবং এ থেকে তাঁর লিখিত গ্রন্থের নাম হয় বাহারিস্তান-ই-গায়েবী। তাঁর পিতা মালিক আলী, (পরবর্তী সময়ে ইহতিমাম খান) রাজকীয় নৌবহরের মীর বহর (নৌবাহিনী প্রধান) হিসেবে ১৬০৮ সালে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতির সঙ্গে বাংলায় আসেন। বীর যোদ্ধা মির্জা নাথান পিতার সঙ্গে ছিলেন এবং রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দেন। সুবাহদার ইসলাম খানের শাসনকালে তিনি মুসা খান, খাজা উসমান ও প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। যখন শাহজাদা শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলায় আসেন তখন মির্জা নাথান শাহজাদার দলে যোগ দেন এবং বিভিন্ন অভিযানে তাঁকে সহায়তা করেন। কিন্তু শাহজাহান বাংলা ত্যাগ করে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার পর মির্জা নাথান সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায় নি। সম্ভবত অবসর জীবনে তিনি তাঁর বিপুলায়তন গ্রন্থ বাহারিস্তান-ই-গায়েবী রচনা করেন।

বাহারিস্তান-ই-গায়েবী কয়েকটি অংশে বিভক্ত এবং প্রতিটি অংশের নাম ‘দফতর’। প্রথম দফতরের নাম ইসলামনামা। এ অংশে সুবাহদার ইসলাম খানের সুবাদারির বিবরণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় দফতরের কোনো নাম দেওয়া হয় নি। এ অংশে কাসিম খান চিশতির সুবাহদারির বর্ণনা আছে। তৃতীয় দফতরের নাম ইবরাহিমনামা। এতে আছে সুবাহদার ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গের সময়ের বর্ণনা। চতুর্থ এবং শেষ দফতরে বিদ্রোহী শাহজাদা শাহজাহানের বাংলা দখলের বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। এ দফতর ওয়াকিয়াত-ই-জাহানশাহী নামে পরিচিত।

দীর্ঘকাল বাহারিস্তান-ই-গায়েবী ইতিহাসবিদদের নিকট অজানা ছিল। স্যার যদুনাথ সরকার প্যারিসের বিবলিওথিকা ন্যাশানাল-এ এ গ্রন্থের একটি পান্ডুলিপি আবিষ্কার করেন। পত্র-পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধাদির মাধ্যমে তিনি বইটি পন্ডিত সমাজের গোচরে আনেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি ফটোকপি সংগ্রহ করে। পরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের প্রফেসর এম.আই বোরাহ তা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। আসাম সরকার ১৯৩৬ সালে এ অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করে। এভাবে দুখন্ডে প্রায় এক হাজার মুদ্রিত পৃষ্ঠায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ভৌগোলিক স্থানের নির্দেশনা সম্বলিত ইংরেজি অনুবাদ খুবই মানসম্মত ও পান্ডিত্যপূর্ণ বলে স্বীকৃত।

গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলির কাল নির্দেশে মির্জা নাথান বেশ কার্পণ্য প্রদর্শন করেন। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বইতে মাত্র চারটি পূর্ণ (দিন, মাস, ও বছর অর্থে) তারিখ দেওয়া আছে। এর মধ্যে আবার তিনটিই তাঁর বর্ণনার মাধ্যমে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং চতুর্থটির সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি। অবশ্য তাঁর বর্ণনা বেশ ইঙ্গিতবহ যার ফলে মোটামুটি কালক্রম নির্ধারণ সম্ভব। এ ইঙ্গিতগুলি হলো রমজান মাস, দুই ঈদ উৎসব, মহররম, শব-ই-বরাত প্রভৃতি মুসলিম উৎসব যা গ্রন্থকার নিজে এবং মুগল সৈন্যরা উদ্যাপন করে। বইটি লেখা শুরু ও শেষ করার তারিখ দেওয়া নেই। লেখক শুধু তৃতীয় দফতরের সূচনায় ৭ জিলকদ (১০) ৪১ হিজরি, সাহিব-ই-কিরানের (শাহজাহান) সিংহাসনারোহণের পঞ্চম বছর (২৭ মে ১৬৩২) বলে উল্লেখ করেন এবং আরও জানান যে, এটি (তৃতীয় দফতর) ‘হূদয় থেকে জিহ্বায় এবং জিহ্বা থেকে কলমে আসে’। গ্রন্থটির খালি পাতায় উল্লেখ আছে যে, পান্ডুলিপিটি নওয়াব আসালাত খানকে দেওয়া হয় এবং তিনি ১ রবিউল আউয়াল ১০৫১ হিজরিতে (১০ জুন ১৬৪১) তাঁর দুধভাই আগা মুহম্মদ বাকিরের নিকট হস্তান্তর করেন। এ থেকে আধুনিক পন্ডিতগণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় দফতর ১৬৩২ সালের পূর্বে শেষ হয় এবং শেষ দুই দফতরের লেখার সমাপ্তি টানা হয় ১৬৪১ সালের পূর্বে। আরও প্রতীয়মান হয় যে, গ্রন্থে বর্ণিত বিষয়াবলি মির্জা নাথান নিজে লিখেন নি। তিনি অন্য কাউকে গ্রন্থের ঘটনা বর্ণনা করেন এবং সেই ব্যক্তি গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বাংলা অধিকারের সমসাময়িক বর্ণনা একমাত্র বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে পাওয়া যায়। অন্যান্য সমসাময়িক উৎস, যেমন সম্রাটের স্মৃতিকথা তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরীতে বাংলার সামান্য কিছু ঘটনাবলির উল্লেখ আছে এবং বেশিরভাগ ঘটনাই বাদ পড়েছে। যুদ্ধাভিযান ও যুদ্ধ, বাংলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পার্শ্বচিত্রের বর্ণনা এখানে পাওয়া যায়, যা অন্য কোনো গ্রন্থে মেলে না। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল সম্পর্কে যেমন বিশদভাবে জানা যায়, বাংলার অন্য কোনো সময়ের ইতিহাস তত ব্যাপক ও বিস্তারিতভাবে জানা যায় না,  এ সত্য থেকেই বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’র গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশেষভাবে অনুধাবন করা যায়।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  mirza nathan, Baharistan-i-Ghaibi, Eng. tr. by M I Borah, Gauhati, 1936; a karim, History of Bengal, Mughal Period, I, Rajshahi, 1992.