বাষ্পীয় যান

বাষ্পীয় যান অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাষ্পীয় শক্তি আবিষ্কারের পর প্রথমে ইংল্যান্ডে চালু হয়। ব্রিটিশরা ভারতে বাষ্পীয় জাহাজ চালু করে এবং ৫০ মিলিয়ন স্টার্লিং পাউন্ড ব্যয়ে প্রায় ২,৬০০ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করে। এর আগে ভারতে প্রাচীন আমলের চলাচল পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। পলি নদী দিয়ে শ্লথগতিতে চলত স্বল্প ওজন বহনোপযোগী দেশীয় নৌকা এবং গ্রামের কর্দমাক্ত পথ দিয়ে চলাচল করত গরুর গাড়ি। সেকালে স্থলপথে পরিবহণ অধিকতর ব্যয়বহুল হওয়ায় যাত্রী ও মাল পরিবহণের জন্য নদীপথই সচরাচর বেছে নেওয়া হতো।

ভারতে ব্রিটিশ শক্তির কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রধান নৌপথ ছিল গঙ্গা নদী। এই নদী থেকে গোয়ালন্দের কাছাকাছি ব্রহ্মপুত্র ও চাঁদপুরের কাছাকাছি মেঘনা নদী দিয়ে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তবে, সেকালে গঙ্গাবক্ষে নৌচলাচলে অনেক অসুবিধাও ছিল। সবচেয়ে বড় নৌকারও মালবহন ক্ষমতা হতে পারত ৬০ টন মাত্র এবং তার সর্বোচ্চ বেগ ছিল ঘণ্টায় অনূর্ধ্ব ছয়-সাত মাইল। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যাত্রী ও মালামাল নদীয়া হয়ে গঙ্গা নদীর তিন শাখা ভাগিরথী, জলাঙ্গি ও মাথাভাঙ্গা দিয়ে পরিবাহিত হতো। এগুলিই আবার মিলিত হয় হুগলি নদীতে, যার পাড়ে ছিল কলকাতা নগরী। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত শুকনা শীত মৌসুমে এ পথে সরাসরি কলকাতায় আসা যেত, কিন্তু বসন্তকালে এসব নদীর শাখাগুলি এত অগভীর হয়ে যেত যে, তাতে ছোট নৌকাও চলতে পারত না, আবার বর্ষাকালে এগুলি এমন কানায় কানায় পূর্ণ হতো যে চলাচলের জন্য ছিল বিপজ্জনক। তারপরও, বাংলার জেলাগুলি থেকে সুন্দরবন হয়ে কলকাতায় যাত্রী চলাচল ও মাল পরিবহণ সম্ভবত বছরের সব সময়েই গঙ্গা নদীর অাঁকাবাঁকা প্রধান প্রবাহ দিয়েই পরিচালিত হতো। এ পথে বাষ্পচালিত যান এসে অনেক সমস্যার সমাধান করে, কেননা প্রচলিত দেশি নৌকার মতো এগুলি জোয়ার ও বায়ুর গতির ওপর নির্ভরশীল ছিল না।

১৮২২ সালে একটি সাধারণ বাষ্পীয় নৌচালনা কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকল্পে ব্যবসায়ী ও জাহাজ চলাচলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগে লন্ডনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে সেকালে উত্তমাশা অন্তরীপ রুটে বাষ্পীয় জাহাজ চালু করে পূর্বের ছয় মাসব্যাপী সমুদ্রযাত্রাকে চার মাসে কমিয়ে আনা। প্রথম পালতোলা বাষ্পীয় পোত এন্টারপ্রাইজ ১৮২৫ সালের আগস্ট ও ডিসেম্বরের মাঝে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করতে পেরেছিল, তবে পরীক্ষামূলক এই সফরকে তেমন সফল বলা যায় না। এতে যাত্রা সম্পন্ন করার আনুমানিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল এবং রোদ ও ধোঁয়া-ময়লার কারণে যাত্রীদেরও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। ১৮২৩ সালে হুগলী নদীতে একটি যাত্রীবাহী বাষ্পীয় যান চালু করা হয়, তবে তা বেশি দিন চালু থাকে নি। ১৮২৬ সালের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপ থেকে আসা সুবিশাল পালতোলা জাহাজকে হুগলি নদীতে আনার জন্য কয়েকটি বাষ্পীয় যানকে টানা-জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। প্রথম থেকেই উদ্যোগের সবটাই ছিল বেসরকারি খাতে।

লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল হিসেবে ১৮২৮ সালে কলকাতায় আসেন। সংস্কারমুখী উদ্দীপনা নিয়ে তিনি ভারতের নদীপথে বাষ্পীয় নৌ চলাচলের ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে মনোযোগী হন। ১৮০৯ থেকে ভারতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহালকৃত এবং এখানকার নদীপথে সাধারণ দেশীয় নৌকায় চলাচল সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা ডবলিউ.টি প্রিন্সেপকে তিনি বাষ্পীয় নৌযান প্রবর্তনের পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা পরীক্ষা করে দেখতে বলেন। ১৮২৮ সালের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন জনস্টনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সদ্য সংগ্রহকৃত নতুন বাষ্পীয় নৌযানসমূহের একটিতে গঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে এলাহাবাদ পর্যন্ত গিয়ে তারপর হুগলীতে ফেরত এসে প্রথম পরীক্ষামূলক সফর সম্পন্ন করা হয়। ১৮৩৪ সালে গঙ্গা নদীতে চলাচলের জন্য একটি নিয়মিত নৌযান সার্ভিস চালু হয়। ১৮২৪-১৮২৬ সালের বার্মা যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে সৈন্যসামন্ত ও সেনা-সরঞ্জাম বহন করার সুবিধার্থে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর দিয়ে একটি বাষ্পীয় নৌচলাচল ব্যবস্থার বিষয় চিন্তাভাবনা করা হচ্ছিল। যুদ্ধ থেমে গেলে যে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় তাতে সীমান্ত অঞ্চল বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের হাতে থাকায় সামরিক উদ্দেশ্যে বাষ্পীয় নৌচলাচল ব্যবস্থার চিন্তাভাবনা বাতিল করা হয়।

উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে উত্তর আসামের চা ধীরে ধীরে বিদেশের বাজারে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকলে সরকার ১৮৪৭ সালে কলকাতা ও গৌহাটির মধ্যে একটি নতুন পথে বাষ্পীয় নৌ সার্ভিস চালু করে। ১৮৫৬ সালে সরকারি নৌ সার্ভিস গৌহাটি থেকে ডিব্রুগড় পর্যন্ত প্রসারিত হয়। তবে, এই নৌ পরিসেবা সাধারণ বাণিজ্যিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম ছিল না। নৌযানের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল এবং ভাড়াও ছিল অত্যধিক। কলকাতা থেকে গৌহাটি পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ছিল কমপক্ষে ১৫০ রুপি। সাধারণ মাল পরিবহণের ভাড়া ছিল প্রতি বর্গফুটে ১ রুপি। তাছাড়া, এসব নদীপথে দেশীয় নৌকায় চলাচলে যে ধরনের বিপদের আশঙ্কা থাকত বাষ্পীয় নৌযান তা থেকে মুক্ত ছিল না।

ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন সাপেক্ষে ভারতের জলপথে নিয়মিত বাষ্পীয় নৌযানের প্রচলন শুরু হয়। কলকাতায় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। গোড়ার দিকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল মেসার্স কিড অ্যান্ড কোম্পানির এবং ১৮২৩ সালে তারা প্রথম যাত্রীবাহী বাষ্পীয় নৌযান ডায়না দিয়ে হুগলি নদীতে পরিবহণ ব্যবস্থা শুরু করে। ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি গঙ্গাবক্ষে একটি বাষ্পীয় নৌ সার্ভিস চালু করেছিল, তবে তারা সদ্যপ্রবর্তিত ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্রহ্মপুত্র নদে একটি নতুন সার্ভিস আরম্ভ করে। ১৮৬২ সালে রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিও কাজ আরম্ভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকের দিকে ইন্ডিয়ান স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি মেঘনা নদীবক্ষেও বাষ্পীয় নৌচলাচল শুরু করে। জলপথে চলাচলের এই নতুন ব্যবস্থার ফলে পূর্ববাংলায়ও মাল পরিবহণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং তা নতুন নতুন জাহাজ কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে থাকে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময় হতে ভারতে রেল যোগাযোগের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। তুলনামূলকভাবে কম ব্যয় ও স্বল্পতর সময়ের এই পরিবহণ ব্যবস্থা বৃহত্তর পরিসরে স্থল পরিবহণ সুগম করে তোলে। প্রচলিত পরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে এর প্রবল প্রতিযোগিতা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে, পূর্ববাংলায় অবস্থা ছিল ভিন্ন। এ অঞ্চলে ষাটের দশকের প্রথমদিকে  ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে চালু হয়েও এ অঞ্চলের নদীপথে চলাচলকারী বাষ্পীয় নৌ সার্ভিসে কোন উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে নি। নদীমাতৃক এই অঞ্চলে নৌ চলাচলের গুরুত্ব আগের মতোই রয়ে যায়। ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে পাবনার থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত চালু করা হয় এবং ১৮৭০ সালে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল গোয়ালন্দ পর্যন্ত তা বর্ধিত করা হয়।

পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে প্রবাহিত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীসমূহ থেকে এবং আসাম ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকেও বছরের অধিকাংশ সময়ে ঘোরা পথে দেশীয় নৌকায় সুন্দরবন হয়ে গঙ্গার প্রধান খাল দিয়ে যেসব যাত্রী ও মাল কলকাতার দিকে পরিবাহিত হতো, আশা করা হয়েছিল, সেগুলি সবই নতুন রেলপথে কলকাতা পৌঁছনোর জন্য গোয়ালন্দমুখী হবে। কিন্তু রেলপথটি চালু হবার পরও কয়েক বছর পর্যন্ত কার্যত এর ব্যবহার বেশ ধীরগতিতেই চলতে থাকে এবং যাত্রী ও মাল পরিবহণে বাষ্পীয় নৌযান ও দেশীয় নৌকার ব্যবহার আগের মতোই বহাল থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ও মেঘনা নদীর শাখাসমূহ, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর সংযোগস্থলে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক কেন্দ্রসমূহের ভেতর দিয়ে ঢাকা জেলার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ছিল এবং এ জেলা দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে জলপথেই যোগাযোগ রক্ষা করত। এ জেলা নারায়ণগঞ্জের মধ্য দিয়ে কলকাতার সঙ্গে বাষ্পীয় নৌযানের মাধ্যমে নিয়মিত চলাচল ব্যবস্থা বহাল রেখেছিল। সিলেট জেলা থেকেও বাষ্পীয় যানযোগে এ অঞ্চলের চা ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করা হতো।

পরবর্তী বছরগুলিতে এ অঞ্চলে অনেক ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থায় অনেকগুলি পর্যায়ক্রমিক উন্নয়ন সাধিত হয়। তবে, নৌ পরিবহণ ব্যবস্থা এখনও বহুল প্রচলিত এবং অভ্যন্তরীণ নদীপথে বাষ্পীয় নৌযানের ব্যবহার আজও যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে টিকে আছে। ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা রুটে এবং উপকূলীয় যোগাযোগ পথে এখনও বাষ্পীয় নৌযান যাত্রী ও মাল পরিবহণের কাজ করে থাকে।  [হেনা মুখার্জী]