বার্ধক্য

বার্ধক্য একটি স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনা এবং মন্থর ও আনুক্রমিক গতিতে এগিয়ে আসা দৈহিক অবক্ষয় যার ফলে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মক্ষমতা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর অবধারিত পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। সাধারণভাবে বার্ধক্য দ্বারা প্রায়ই বয়োবৃদ্ধির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। এটি অবশ্যম্ভাবী জৈবিক বাস্তবতা, এর একটা নিজস্ব গতি রয়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিরোধক আবিষ্কার সত্ত্বেও তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

কত বয়স অতিক্রান্ত হলে একজন মানুষকে বৃদ্ধ বলে বিবেচনা করা হবে তার কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। উন্নত বিশ্বে বার্ধক্য বিবেচনার ক্ষেত্রে আনুক্রমিক বয়স বড় ভূমিকা পালন করে। কারও বয়স কর্ম থেকে অবসর গ্রহণের বয়সে পৌঁছালে অর্থাৎ ৬৫ বছর হলে তার বার্ধক্য শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে বার্ধক্য নির্ণয়ে আনুক্রমিক বয়সের ভূমিকা ন্যূন। যখন কারও পক্ষে কর্মক্ষেত্রে আর কোন সক্রিয় অবদান রাখা সম্ভব হয় না তখনই এর সূচনা বলে ধরে নেওয়া হয়। তথাপি এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবসর গ্রহণের গড় বয়স, বিদ্যমান আইন, স্বাস্থ্যগত অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্যের পরিসংখ্যানসম্মত বাস্তব সীমা বলে মনে করা যায়। বস্ত্তত ৬০ বছর বয়স থেকে সাধারণভাবে সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা বার্ধক্যের সূচনা বলে নির্ধারণ করেছে। অবশ্য, অঞ্চলভেদে গড় আয়ুর পার্থক্য রয়েছে এবং একজন মানুষের বার্ধক্যের প্রক্রিয়া শুরুতে আরও বহুকিছুর প্রভাব কাজ করে। কোন কোন মানুষ ৩৫ বছর বয়সেই বুড়ো হয়ে যায়, আবার অনেকে ৭০ বছর বয়সের পরও কর্মক্ষমভাবে বেঁচে থাকে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটা ক্ষুদ্র অংশ (৬%) প্রবীণ, তবু তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাটি বেশ উল্লেখযোগ্য (৭২ লক্ষ) এবং প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশ উঁচু। ১৯১১, ১৯৫১, ১৯৮১ এবং ১৯৯১ সালে দেশে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল (৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব) যথাক্রমে ১৩ লক্ষ ৭০ হাজার, ১৮ লক্ষ ৬০ হাজার, ৬০ লক্ষ ৫ হাজার এবং ৪০ লক্ষ ৯০ হাজার। ২০০০, ২০১৫ এবং ২০২৫ সালে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৭২ লক্ষ ৫০ হাজার, ১ কোটি ২০ লক্ষ ৫০ হাজার এবং ১ কোটি ৭৬ লক্ষ ২০ হাজারে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জনসংখ্যার এই বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনের কারণে দেশের সমাজব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ওপর মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।

এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে প্রবীণদের দেখাশোনার ব্যাপারে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে এবং প্রত্যাশা থাকে যে পরিবার ও সমাজ তাদের প্রবীণ সদস্যদের যত্ন নেবে। কিন্তু দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন, ব্যাপক দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং অন্যান্য কারণে ঐতিহ্যবাহী যৌথ পারিবারিক ও সামাজিক দেখাশোনার পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ মানুষই কতগুলি মৌলিক মানবিক সমস্যার শিকার হচ্ছে; এসবের মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান, বার্ধক্যজনিত রোগ এবং যথোপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব, একাকিত্ব ও অবহেলা, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। শতকরা ৮০ ভাগ প্রবীণ পল্লী অঞ্চলে বসবাস করে। নিম্নে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণিভুক্ত প্রবীণদের বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

গ্রামীণ এবং শহুরে দরিদ্র প্রবীণ  এরা চরম দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যহীনতার শিকার। তাদের কোন নিয়মিত আয়ের উৎস নেই এবং এর ফলে তারা খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যাপকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। উল্লেখ করা যায় যে, এই শ্রেণির মানুষ সাধারণত বড় ধরনের মানসিক ও সামাজিক সমস্যার ব্যাপারে কোন অভিযোগ করে না, বরং তারা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি এবং ধর্মের ওপরই পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ও নির্ভরশীল থাকে। শহুরে দরিদ্র প্রবীণরা অবশ্য শহরের কিছু মৌলিক সুবিধা ভোগ করে। তবে তারা প্রতিবেশী এবং অন্যান্য সামাজিক সংস্থার সাহায্য ও সহযোগিতা পায় না বললেই চলে। অন্যদিকে পল্লী এলাকায় দরিদ্র প্রবীণরা তাদের নিকট এবং দূরবর্তী আত্মীয় ও বিত্তবান প্রতিবেশীদের নিকট থেকে সমবেদনা ও সাহায্য পেয়ে থাকে।

পল্লী এলাকার স্বচ্ছল প্রবীণ  এই শ্রেণিভুক্ত প্রবীণরা হচ্ছে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ পর্যায়ের কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ঐতিহ্যবাহী ও উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মানুষ। তারা যথেষ্ট সম্মান, সেবা এবং প্রতিপত্তি নিয়ে তাদের একান্নবর্তী পরিবারে বাস করে।

শহুরে মধ্যবিত্ত প্রবীণ  এই শ্রেণিভুক্ত প্রবীণদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল। অবসরপ্রাপ্ত মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তা অথবা ব্যবসায়ী এই শ্রেণিভুক্ত। এদের অধিকাংশেরই নিজস্ব নিরাপদ আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। এদের অধিকাংশই যৌথ পরিবারে বাস করে এবং পল্লী এলাকার স্বচ্ছলদের অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। তবে তাদেরকে শহরের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতা, টেনশন, একাকিত্ব এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয়। তারা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করে।

শহুরে ধনী প্রবীণ এই শ্রেণিভুক্তগণ হচ্ছে মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অথবা বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক। এই শ্রেণিভুক্ত প্রবীণরা কদাচিৎ আর্থিক সমস্যার মোকাবেলা করে। তাদের পরিবার ও সমাজের সদস্যগণ সাধারণত তাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে এবং তাদের মতামতের মূল্য দেয়। তবে এই শ্রেণিভুক্ত প্রবীণরা প্রায়শই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন, একাকী এবং অবহেলিত বলে মনে করে; কারণ সাধারণত তাদের পুত্র-কন্যাগণ তাদের সাথে থাকে না, এবং নিজ নিজ কাজে নিজস্ব পরিমন্ডলে ব্যস্ত থাকে। এই শ্রেণিভুক্ত প্রবীণরা সামাজিক নেতৃত্ব প্রদান করে অথবা ধর্মীয় কর্মকান্ড ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিজেদের নিয়োজিত রাখে।

উপরে বর্ণিত শ্রেণিগুলি ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের প্রবীণ রয়েছে। এদের মধ্যে আছে দৈহিক, মানসিক অথবা সামাজিকভাবে প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ, বয়স্ক বিধবা, বিপত্নীক, চিরকুমার বা কুমারী অথবা এমন মানুষ যাদের কোন নিকট আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব নেই। এসব মানুষ বার্ধক্যের সমস্যাটিকে আরও তীব্রভাবে মোকাবেলা করে। সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীলতা, নিরাপত্তহীনতা, হীনমন্যতাবোধ, সহায়হীনতা, ভাগ্যনির্ভরশীলতা এবং অধিক ধর্মীয় কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ তাদের নিত্যসঙ্গী। এই শ্রেণিভুক্ত প্রবীণদের জন্য সমাজের নিকট থেকে বিশেষ সেবা ও দেখাশোনা প্রয়োজন এবং তারা তা পাবার যোগ্য।

গড়পড়তা বাংলাদেশি পরিবারে প্রায়শই বয়স্ক লোকদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। বৃদ্ধরা পথে ভিক্ষা করছে অথবা অন্যের দয়া প্রার্থনা করছে এ ধরনের দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। ভগ্নস্বাস্থ্য হওয়া সত্ত্বেও এসব প্রবীণদের অনেককেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হতে দেখা যায়। অগণিত প্রবীণ হতাশার মধ্যে এবং রোগ-শোকে ভুগে কোন সেবা ও সাহচার্য ছাড়াই দিন কাটায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য দুধরনের সেবা-যত্নের ব্যবস্থা রয়েছে, প্রথাগত অথবা স্থানীয় এবং আধুনিক। আধুনিক সেবাগুলি দেওয়া হচ্ছে সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোগে। প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী সেবাগুলির মধ্যে রয়েছে আত্মীয় ও পরিবারের সেবাযত্ন, দয়াদাক্ষিণ্য ও ভিক্ষা প্রদান, এবং মসজিদ, কবরস্থান, মাযার, দরগাহ ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় প্রদান।

সরকারি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৯২৪ সালে প্রবর্তিত পেনশন ব্যবস্থা, যে সুযোগ কেবল মুষ্টিমেয় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী এবং শিল্প শ্রমিকরা পায়। সম্প্রতি ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময় সরকার বয়স্ক ভাতা (বৃদ্ধদের দেয় ভাতা) নামে একটি নতুন পেনশন প্রকল্প চালু করেছে। এর আওতায় প্রতিটি ইউনিয়ন/ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র ১০ জনকে (৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলা) প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু গ্রাম বা শহর অঞ্চলে বসবাসকারী সকল দরিদ্র প্রবীণদের জন্য কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বিশেষভাবে বৃদ্ধদের জন্য কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তাদের সেবা অবশ্য হাসপাতাল এবং বহির্বিভাগে প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণদের জন্য নিবাস পরিচালনা, বয়োবৃদ্ধদের জন্য বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি, আলোচনা সভা, ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণ, গবেষণা এবং প্রকাশনা কর্মকান্ডে সীমিত। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সমিতি এবং বয়স্কদের ঔষধ সরবরাহ ইনস্টিটিউট হচ্ছে দেশের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান যারা ১৯৬০ সাল থেকে প্রবীণদের মঙ্গলার্থে কাজ করে আসছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বার্ধক্য-সংক্রান্ত বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে।  [এ.এস.এম আতিকুর রহমান]