বাট্টা

বাট্টা  মুগল ও মুগল-পূর্ব যুগে বাজারে প্রচলিত নিম্নমানের টাকার ওপর আরোপিত অধিহার বা কর্তন। সুলতানি আমল থেকেই বাট্টা প্রথার প্রচলন দেখা যায়, তখন অর্থ-বাজারে বিচিত্র ধরনের স্থানীয় ও বৈদেশিক রৌপ্যমুদ্রা চালু হয়। বাট্টার মাধ্যমে অসম মূল্যের মুদ্রাগুলিকে মানসম্পন্ন মুদ্রার সমতুল্য করা হতো। বহুমুদ্রা অর্থনীতির ফসল হিসেবে বাট্টা মুগল আমলে বেশ জটিলতা সৃষ্টি করে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও মুদ্রানীতি হিসেবেও মুগল আমলে একজন নতুন সম্রাট তার সিংহাসনারোহণ উপলক্ষে ‘সিক্কা’ নামক রৌপ্য নির্মিত নতুন মুদ্রা জারি করতেন। প্রথাগতভাবে পূর্ববর্তী শাসনামলের মুদ্রা ‘সানত’ বা অচল ঘোষণা করা হতো এবং সেগুলি ক্ষতিপূরণ বাট্টা বা অধিহার ছাড়া রাজকোষে গ্রহণ করা হতো না। শাসক পরির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে লোকজন রাজকোষ বা সররফদের (মুদ্রা ব্যবসায়ী) কাছ থেকে টাকশাল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত হারে বাট্টা প্রদান করে নতুন সিক্কা সংগ্রহ করত। রাজনৈতিক দিক থেকে বাট্টা প্রথা একদিকে রায়ত বা প্রজাদের কাছে একজন নতুন শাসকের সিংহাসনারোহণের প্রজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করত এবং অন্যদিকে সৃষ্টি করত রাজস্বের এক তাৎক্ষণিক উৎস। আঠারো শতকে বাট্টা প্রথা চরম জটিল রূপ ধারণ করে। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাণিজ্যিক কার্যক্রমের প্রভাবে ব্যবসায়ীরা ভারতের সকল টাকশালে উৎকীর্ণ মুদ্রা বাংলায় নিয়ে আসে এবং এর ফলে মুদ্রাবাজারে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুর্শিদাবাদ টাকশালে উৎকীর্ণ সিক্কা রুপি ছাড়াও বাজারে মাদ্রাজ রুপি, আর্কট রুপি, পাটনা রুপি প্রভৃতি আরও বহু রকমের রুপি চালু ছিল। সৌকর্য ও ওজনের দিক থেকে এ সকল মুদ্রার মধ্যে পার্থক্য ছিল। মুর্শিদাবাদ টাকশালে উৎকীর্ণ মুদ্রা ছাড়া বাকি সব মুদ্রা ‘সানত’ বা অচল হিসেবে ঘোষিত হয়। এমনকি জারি হওয়ার তিন বছরের মধ্যেই মুর্শিদাবাদের সিক্কাও সানত ঘোষিত হয়। এ সকল মুদ্রার ঘাটতি বাট্টা প্রদানের মাধ্যমে সিক্কা রুপির সঙ্গে সমন্বিত করা হতো। সিক্কা রুপিতেই রাজস্ব আদায় করা হতো। কাজেই রাজস্বদাতাদের বাট্টা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সানত বা অচল মুদ্রা সিক্কা রুপিতে রূপান্তরিত করতে হতো। ফলে গ্রামাঞ্চলে মুদ্রাবদলকারী সররফদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারাই বাট্টার হার নির্ধারণ করত বলে নিজেদের খুশিমতো বাট্টা দাবি করত। প্রথমে দর্শনী হুন্ডি (promissory bank notes) প্রবর্তন এবং পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কর্তৃক নিয়মিত কাগজি মুদ্রা চালু করার ফলে মুদ্রাবাজারে বাট্টা সমস্যার অবসান ঘটে।  [সিরাজুল ইসলাম]