বাইগুনবাড়ি শিকারকানন

বাইগুনবাড়ি শিকারকানন  ঢাকার নওয়াবদের একটি শিকার ও প্রমোদ কানন। সাভারের বিরলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর মৌজায় বাইগুনবাড়ির অবস্থান। খাজা আলীমুল্লাহর সময় এ শিকারকাননটির কাজ শুরু হলেও নওয়াব খাজা আবদুল গণির সময়েই তা পূর্ণতা পায়। উক্ত এলাকায় উঁচু-নিচু পাহাড়ি পরিবেশের জলা-জঙ্গলে শিকারের পশু-পাখি পালন করার বিশেষ সুবিধা ছিল। ঢাকার নওয়াবগণ সাদুল্লাপুরের বিস্তৃত বনভূমিকে অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। স্থানটির দুদিকে খোলা মাঠ ও বিল থাকায় সেখানে পশুপাখি পালন ও শিকারের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল। দেশ-বিদেশ থেকে উন্নত জাতের হরিণ, ময়ূর, বনমোরগ, তিতির, খরগোস প্রভৃতি পশুপাখি এনে ঢাকার নওয়াবগণ সংরক্ষিত বনে ছেড়ে দিয়ে তাদের বংশ বিস্তারের ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও বনের ধারে বিল এলাকায় পাওয়া যেত প্রচুর শিকারযোগ্য বরাহ এবং দেশী-বিদেশী নানা জাতের প্রচুর পাখি। নওয়াবের নিজস্ব লোক ছাড়া কেউ সেখানে শিকার করতে পারত না। ১৮৯৫ সালে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ তাঁর এ বন এলাকায় অননুমোদিত শিকারীদের সাবধান করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন, এখানে অনুমতি ছাড়া শিকার করলে তাকে ফৌজদারিতে সোপর্দ করাসহ ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে।

বাইগুনবাড়ি শিকারকাননের প্রমোদ ভবন

বাইগুনবাড়িতে শিকার আয়োজনের যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল। বিভিন্ন সময়ে নওয়াবগণ উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সেখানে নিয়ে শিকারের আনন্দ উপভোগ করাতেন। অনেক সময় ইংরেজ সাহেবরা নওয়াবের অনুমতি নিয়ে নিজেরাই সেখানে শিকার করতে যেতেন। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে পরিবার-পরিজন ও পাইক-পেয়াদা সমভিব্যহারে ঢাকার নওয়াবগণ বাইগুনবাড়িতে গিয়ে অবস্থান করতেন। শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় হাতি, ঘোড়া, লোক-লস্করও নেওয়া হতো।

সেখানে তাঁদের থাকা-খাওয়া ও আমোদ-প্রমোদের জন্য উপযুক্ত ভবনও নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে ছিল সদরকোঠা, রঙমহল, আবাসগৃহ, বেগমদের জন্য উপযুক্ত অন্দরমহল। দাস-দাসী, পাইক-পেয়াদাদের জন্য প্রয়োজনীয় গৃহও নির্মাণ করা হয়েছিল। বাইগুনবাড়িতে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ইমারত ছিল একটি দ্বিতল প্রাসাদ ভবন। ভবনটির উভয় তলায় এগারোটি করে বড় বড় অর্ধবৃত্তাকার খিলান সহযোগে তৈরি উন্মুক্ত বারান্দা ছিল দর্শনীয়।

এখানকার অন্দরমহলটি একতলা ভবন হলেও অনুরূপ সুদৃশ্য খিলানি বারান্দা সহযোগে নির্মিত হয়েছিল। দেশী-বিদেশী নানা জাতের বাহারি গাছ এবং ফুল ও ফলের বাগান দিয়ে বাইগুনবাড়ির প্রাসাদ এলাকা সাজানো ছিল।

বাইগুনবাড়িতে নওয়াব আহসানুল্লাহ একটি সুন্দর জামে মসজিদ এবং দুটি দিঘি খনন করিয়েছিলেন। কালের প্রবাহে এখানে নির্মিত ঢাকার নওয়াবদের অন্যসব কীর্তিকলাপ বিলীন হয়ে গেলেও উক্ত জামে মসজিদ ও এর সংলগ্ন বৃহৎ দিঘিটি আজও টিকে রয়েছে। এছাড়া নওয়াবদের আমলের একটি ভগ্নপ্রায় দালান এখন সরকারের তহশিল অফিসরূপে ব্যবহূত হয়। সেখানে এখন একটি বাজার গড়ে উঠেছে, যাকে সাদুল্লাপুরের বাজার বলা হয়।

ঢাকার নওয়াবগণ সাধারণত লঞ্চ বা বজরায় করে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীপথে বাইগুনবাড়িতে যাতায়াত করতেন। তুরাগ নদী থেকে আবার একটি বড় খাল বেরিয়ে বাইগুনবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। উক্ত খাল দিয়েই বাইগুনবাড়ির শান বাঁধানো ঘাটে পৌঁছা যায়। ঘাটটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, খালটিও ভরাট হয়ে গেছে। ১৮৯৬ সালে বাইগুনবাড়িতে যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য তুরাগ নদীর পলিচর অপসারণ করা হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ৪ মার্চ ঢাকার সঙ্গে বাইগুনবাড়ির টেলিফোন লাইন চালু করা হয়।

নওয়াব আবদুল গণি ১৮৬০ সালে বাইগুনবাড়ি এলাকায় ত্রিশ বিঘা জমি পরিষ্কার করে সেখানে চা-বাগান তৈরি করেন। তিনি সেখানে ব্যবহার করেছিলেন কাছাড় বীজ এবং ১৮৬৭ সালে সেখান থেকে পেয়েছিলেন আড়াই মণ চা। নওয়াব আহসানুল্লাহ চা বাগানটির আরও উন্নয়ন করেন। ১৮৯২ ও ১৮৯৩ সালে ঢাকা থেকে যথাক্রমে ৪৭০৯ মণ এবং ১৩৮৫ মণ চা-পাতা কলকাতায় রপ্তানি হয়েছিল। এ চায়ের একটা বড় অংশই নওয়াবের উক্ত বাগানে উৎপন্ন হয়েছিল। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাইগুনবাড়ি চা-বাগানটি টিকে থাকে নি।  [মোহাম্মদ আলমগীর]