বাংলাদেশের ভূতত্ত

বাংলাদেশের ভূতত্ত্ব (Bangladesh Geology) বিশ্বের বৃহত্তম গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চলের বৃহদংশ জুড়ে রয়েছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপীয় অববাহিকা, যা বঙ্গ অববাহিকা নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন মূলত হিমালয় পর্বতমালার উত্থান ও হিমালয়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা বৃহৎ নদী-ব্যবস্থা উদ্ভূত বদ্বীপীয় স্থলভাগ সম্পর্কিত। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে রয়েছে কোন অববাহিকার দ্রুত অবনমন ও ভরাট প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পুরুত্বের বদ্বীপীয় অবক্ষেপ উপলেপিত হয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর বিশাল বদ্বীপীয় অঞ্চল গড়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগরে বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয় এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী ব্যবস্থার একটি বিস্তৃত প্রবাহ ধারার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া পুষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল উত্থিত ও পাহাড়ময়। পূর্ব দিকে অবস্থিত ইন্দো-বার্মা পবর্তমালার সূচনাবলয়ে এটি যুক্ত। উল্লিখিত যাবতীয় ভূ-গাঠনিক ক্রিয়াকর্ম ভারতীয় প্লেটের এশীয় প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট।

বাংলাদেশের ভূতত্ত্ব নিম্নের তিনটি শিরোনামে আলোচনা করা যায়: ১) ভূ-গাঠনিক রূপরেখা, ২) স্তরবিদ্যা ও ৩) অর্থনৈতিক ভূতত্ত্ব।

ভূ-গাঠনিক রূপরেখা  বাংলাদেশ দুটি প্রধান ভূ-গাঠনিক ইউনিটে বিভক্ত: ক) উত্তর পশ্চিমের সুস্থিত প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্ম ও খ) দক্ষিণ-পূর্বের মহীখাতীয় অববাহিকা। হিঞ্জ অঞ্চল (Hinge zone) নামের একটি সংকীর্ণ উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রবণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত একটি তৃতীয় ইউনিট দেশের প্রায় মাঝ বরাবর উপরোক্ত দুটি ইউনিটকে বিভক্ত করে রেখেছে।

সুস্থিত প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্ম রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল নিয়ে গঠিত। প্রাক-ক্যামব্রীয় আগ্নেয় ও রূপান্তরজ ভিত্তিশিলার উপর সীমিত থেকে মাঝারি পুরুত্ববিশিষ্ট পাললিক শিলার আস্তর এর বৈশিষ্ট্য। আপেক্ষিক অর্থে এই ইউনিট ভূতাত্ত্বিকভাবে সুস্থিত এবং ভঙ্গিল বিচলনের (Fold movement) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। কিছু চ্যুতিবেষ্টিত গ্রস্ত-অববাহিকা প্রাক-ক্যামব্রীয় ভিত্তিশিলার আওতাভুক্ত অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। এই সব অববাহিকা পার্মিয় যুগের (আজ থেকে ২৮৬-২৪৫ মিলিয়ন বছর আগে) কয়লাবাহী শিলার ইউনিট ধারণ করে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত এটিই সর্বাধিক প্রাচীন পাললিক শিলা। বাংলাদেশে প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্ম দুভাগে বিভক্ত: খুবই অগভীর প্রাক-ক্যামব্রীয় ভিত্তিশিলা (১৩০ থেকে ১০০০ মিটার) বিশিষ্ট উত্তরাঞ্চলীয় রংপুর অবতল (Rangpur saddle) এবং মাঝারি গভীরতা সম্পন্ন (১-৬ কিমি) দক্ষিণাঞ্চলীয় বগুড়া সোপান। বগুড়া সোপানে পাললিক স্তরসমূহ হিঞ্জ অঞ্চল পর্যন্ত খুব আলতোভাবে দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর নতিশীল এবং এরপর হঠাৎ করে এই ঢাল ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে এবং পাললিক ইউনিটসমূহ অতল গভীরে নেমে দক্ষিণ-পূর্বে গভীর মহীখাতীয় অববাহিকার মধ্যে এসে পড়েছে।

দক্ষিণ-পূর্বের মহীখাতীয় অববাহিকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যাপক পুরুত্বের (অববাহিকার কেন্দ্রে সর্বাধিক প্রায় ২০ কিমি) ক্লাসটিক পাললিক শিলা (clastic sedimentary rock), যার অধিকাংশ বেলেপাথর ও টারশিয়ারী যুগের কর্দম শিলা। বৃহত্তর ঢাকা-ফরিদপুর-নোয়াখালী-সিলেট-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগর এর অন্তর্গত।

অববাহিকায় অবক্ষেপের ব্যাপক পুরুত্বের কারণ এই সব অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক গতিশীলতা অথবা অস্থিতিশীলতা, যা ভূতাত্ত্বিক কালের হিসাবে তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে দ্রুত অবনমন ও অবক্ষেপণ সংঘটিত করছে। মহীখাতীয় অববাহিকা দুই ভাগে উপভাঁজিত, যথা- পূর্বাঞ্চলীয় বলিত বলয় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় পুরঃখাত। বলিত বলয়ের বৈশিষ্ট্যের কারণে পাললিক স্তরসমূহ ধারাবাহিক উত্তলভঙ্গ (ঊর্ধ্বমুখী ভাঁজ) ও অবতলভঙ্গে (নিম্নভাঁজ) ভঙ্গিল রূপ ধারণ করেছে। উত্তলভঙ্গসমূহ পাহাড়ের এবং অবতলভঙ্গসমূহ উপত্যকার সৃষ্টি করেছে যা পূর্বাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-সিলেট অঞ্চলের ভূ-সংস্থানে পরিদৃশ্যমান। পূর্বদিকে এই ভঙ্গিলতার পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-সংস্থানিক উচ্চতা বেশি। এই ভঙ্গিলতার মাত্রা পশ্চিমে যতই কমতে থাকে বলিত বলয়ের ইউনিটসমূহ পুরঃখাত ইউনিটের সঙ্গে ততই মিশে যেতে থাকে যার ফলে শুধু হাল্কা অথবা কোন ভঙ্গিলতাই পরিদৃষ্ট হয় না। অতএব পাললিক স্তরসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আনুভূমিক বা উপানুভূমিক এবং অববাহিকার মধ্যভাগ দখলকারী পুরঃখাত অঞ্চলে বড় ধরনের ভূ-গাঠনিক বিকৃতি থেকে মুক্ত। আর বাংলাদেশের নদীজ থেকে বদ্বীপীয় ভূ-সংস্থান এরই বহিঃপ্রকাশ।

২৫ কিমি চওড়া উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলবিশিষ্ট হিঞ্জ অঞ্চল (Hinge zone/Palaeo Continental Slope) উত্তর-পশ্চিমের প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্মকে দক্ষিণ-পূর্বের মহীখাতীয় অববাহিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই ইউনিটের কোন ভূ-পৃষ্ঠগত দ্যোতনা বা অভিব্যক্তি না থাকলেও অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠ পাললিক স্তরসমূহে নতির আকস্মিক বৃদ্ধি এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ইয়োসিন যুগের সিলেট চুনাপাথর ইউনিটের মাথায় সিসমিক নির্দেশে পরিষ্কারভাবে এটা ধরা পড়েছে, যে কারণে এটি ইয়োসিন হিঞ্জ অঞ্চল নামেও পরিচিত।

স্তরবিদ্যা  বাংলাদেশে শিলা অনুক্রমের স্তরীয় উপভাজন ব্যাপক ভূ-গাঠনিক বিভাজনের অনুসরণে করা হয়ে থাকে। প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্মে ঐ অঞ্চলের আপেক্ষিক ভূ-গাঠনিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পার্মীয় থেকে সাম্প্রতিক যুগের একটি পাতলা থেকে সীমিত পাললিক অনুক্রম একটি কেলাসিত ভিত্তিশিলার উপর অধিশায়িত। অন্যদিকে মহীখাতীয় অববাহিকায় প্রধানত টারশিয়ারী যুগের একটি অতিবৃহৎ সংঘাত ক্রমের (clastic sequence) উপস্থিতি উচ্চ ভূ-গাঠনিক বিচলনের প্রমাণ দেয়। বাংলাদেশের স্তরবিদ্যা উক্ত দুটি বিভাজনের প্রেক্ষাপটে দুটি শিরোনামে আলোচিত হয়: ক) প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্মের স্তরবিদ্যা: উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বাংলাদেশে প্রাক-ক্যামব্রীয় আগ্নেয় এবং রূপান্তরিত শিলাসমূহ সকল পাললিক শিলা ইউনিটের ভিত তৈরি করেছে। প্রাক-ক্যামব্রীয় ভিত্তিশিলা প্রধানত গ্র্যানাইট, গ্রানোডায়োরাইট ও নাইস (Gneiss) দ্বারা গঠিত। এই ভিত্তিশিলা রংপুর এলাকায় সবচেয়ে কম গভীরে ভূ-পৃষ্ঠের ১৩০ মিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত এবং পার্মীয় থেকে সাম্প্রতিক কালের বয়স সম্পন্ন ক্রমবর্ধমান পাললিক আচ্ছাদনে দক্ষিণ-পূর্ব অভিমুখে নতিশীল।

পার্মীয়  বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন পাললিক ইউনিট হচ্ছে পার্মীয় যুগের গন্ডোয়ানা গ্রুপ, যা অসঙ্গতভাবে প্রাক-ক্যামব্রীয় কেলাসিত ভিত্তিশিলাতে ভর দিয়ে আছে। গন্ডোয়ানা গ্রুপ কিছু কয়লা ও কর্দম শিলা স্তরসহ কঠিন বেলেপাথরে গঠিত। এই গ্রুপ প্রায় ১০০০ মিটার পুরু এবং চ্যুতিবেষ্টিত গ্রস্ত অববাহিকায় (Graben basin) দেখা যায়।

জুরাসিক-ক্রিটেসিয়াস  গন্ডোয়ানা গ্রুপের অবক্ষেপের উপরে রাজমহল শিলা সোপান স্তরসমষ্টি (Rajmahal Trap formation) নামে জুরাসিক কালের আগ্নেয় ব্যাসল্ট শিলার একটি অনুক্রম অবস্থিত। সংলগ্ন ভারতের রাজমহল পাহাড়ের অনুসরণে এই নামকরণ। সেখানে ইউনিটটি ভূ-পৃষ্ঠের উপরে দৃশ্যমান। ইউনিটটি প্রায় ৫০০ মিটার পুরু এবং রাজশাহী-বগুড়া অঞ্চলে খননকৃত কূপে এটি দেখতে পাওয়া যায়। রাজমহল শিলা সোপান শিবগঞ্জ আবদ্ধিক স্তরসমষ্টি (Shibganj Trapwash Formation) দ্বারা অধিশায়িত। এই স্তরসমষ্টি ফেরুজিনাস বেলেপাথর ও কাদাপাথরে গঠিত আগ্নেয় শিলার আবহিক বস্ত্তর অপেক্ষাকৃত পাতলা আবরণ। বয়সে এটি ক্রিটেসিয়াস যুগের।

প্রাক-টারশিয়ারী  পরবর্তী ঊর্ধ্বমুখী শিলাক্রমের নাম দেওয়া হয়েছে জৈন্তিয়া গ্রুপ। প্যালিওসিন ও ইয়োসিন যুগের এই শিলাক্রম সামুদ্রিক পরিবেশে গঠিত হয়েছিল। জৈন্তিয়া গ্রুপ তিনটি ইউনিটে বিভক্ত। নিচ থেকে উপরের দিকে এগুলির নামকরণ হচ্ছে- তূরা স্তরসমষ্টি, সিলেট চুনাপাথর স্তরসমষ্টি এবং কপিলি কর্দমশিলা। তূরা স্তরসমষ্টি প্রধানত উপরের দিকে মাঝে মাঝে পাতলা কয়লা স্তরসহ সাদাটে বেলেপাথরে গঠিত। এর উপরে মধ্য ইয়োসিন যুগের নুমুলাইটিক (nummulitic) শিলাভূত চুনাপাথর ইউনিটসমূহে গঠিত সিলেট চুনাপাথর স্তরসমষ্টি অবস্থিত। এর গড় পুরুত্ব ২৫০ মিটার। সিলেট চুনাপাথর স্তরসমষ্টি উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বাংলাদেশের অন্তর্ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গঠিত ইউনিট এবং ভূকম্পীয় শাখায় একটি নির্দেশক দিগন্ত বিশেষ। অধিশায়িত কপিলি স্তরসমষ্টি কিছু চুনাপাথর স্তরসহ গাঢ় ধূসর থেকে কালো শিলাভূত কদর্ম শিলা দ্বারা গঠিত। ইউনিটটির পুরুত্ব ৪০ থেকে ৯০ মিটার এবং এটি অবক্ষেপের উন্মুক্ত সামুদ্রিক অবস্থার সমাপ্তি নির্দেশ করে।

নবীন-টারশিয়ারী (Late Tertiary)  ১৫০ থেকে ২০০ মিটার পুরু এবং মাঝে মাঝে অঙ্গারময় স্তরমালার সঙ্গে বেলেপাথর, কর্দম ও পলি শিলায় গঠিত বড়াইল গ্রুপ (The Barail Group) ওলিগোসিন যুগে বদ্বীপীয় পরিবেশে অবক্ষেপণ প্রক্রিয়াকে তুলে ধরে। বড়াইল গ্রুপ প্রায় ৪০০ মিটার পুরু এবং বদ্বীপীয় বেলেপাথর, কর্দম ও পলি শিলায় গঠিত সুরমা গ্রুপ দ্বারা (অপৃথকীকৃত ও জামালগঞ্জ স্তরসমষ্টি হিসেবে প্রায়ই অভিহিত) অধিশায়িত। বড়াইল গ্রুপ ও সুরমা গ্রুপের পুরুত্ব মহীখাতীয় অববাহিকা অঞ্চলের তুলনায় সুস্থিত সোপানে অনেক কম। সুরমা গ্রুপ প্লায়োসিন-প্লাইসটোসিন যুগের ডুপিটিলা স্তরসমষ্টি দ্বারা অধিশায়িত। প্রায় ২৭০ মিটার পুরু সুরমা গ্রুপ মাঝারি থেকে মোটা দানার বেলেপাথর দিয়ে গঠিত এবং প্রায়শই নুড়িময়। এই ইউনিট অববাহিকার বদ্বীপ দ্বারা ভরাট হওয়ার কারণে নদী তীরবর্তী সমতল ভূমির অবক্ষেপের প্রতিভূ। অধিশায়িত ডিহিং স্তরসমষ্টি (Dihing Formation) নদীবাহিত নুড়িবালু ও মাঝে মাঝে কাঁকর অবক্ষেপে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং প্রায় ১৫০ মি পুরু। উপরিউক্ত সকল স্তরসমষ্টি সাম্প্রতিক কালের বঙ্গীয় পললের (Bengal Alluvium) প্রায় ১০০ মিটার নরম বালুময়, পলিকণা ও কর্দম অবক্ষেপে অবলোপিত।

মহীখাতীয় অববাহিকার স্তরবিদ্যা  বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্ল্যাটফর্ম অংশের বিপরীতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মহীখাতীয় অববাহিকার স্তরবিদ্যা প্রধানত বয়সে টারশিয়ারী যুগের ব্যাপক পুরুত্ববিশিষ্ট একটি পাললিক স্তরক্রম (প্রায় ২০ কিমি পর্যন্ত) দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত যেখানে দ্রুত অবনমন ও অবক্ষেপণ সংঘটিত হচ্ছে। প্রাক ওলিগোসিন শিলাসমূহ খুবই গভীরে প্রোথিত হওয়ায় মহীখাতীয় অববাহিকার খনন কূপ অথবা উদ্ভিদে ওলিগোসিন যুগের চেয়ে পুরানো শিলার সন্ধান পাওয়া যায় নি।

উত্তর-টারশিয়ারী  বড়াইল গ্রুপ ওলিগোসিনের প্রতিনিধিত্ব করে। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ভারতের বড়াইল পর্বতমালারও প্রতিনিধিত্ব করে। পার্শ্ববর্তী ভারতের বড়াইল পর্বতমালার অনুসরণে এই নাম। বড়াইল গ্রুপ পরিবর্তী বেলেপাথর, কর্দম শিলা, পলিপাথর এবং মাঝে মাঝে কার্বনসমৃদ্ধ স্তরে গঠিত। প্রতিবেশী আসামে প্রায় ৩,০০০ মিটার বড়াইল অবক্ষেপের দৃশ্যমান শিলাস্তর রের্কড করা হয়েছে এবং ইউনিটটি তিনটি স্তরসমষ্টিতে বিভক্ত। বাংলাদেশে বড়াইল গ্রুপের অধিকাংশই খুব গভীরভাবে প্রোথিত, যদিও বড়াইলের ৩৫০ মিটারের মতো ঊর্ধ্বাংশ ভারত সংলগ্ন উত্তরাঞ্চলীয় সিলেট সীমান্তের জৈন্তিয়াপুরের এক ফালি ক্ষুদ্র জমিতে প্রকাশমান। বড়াইল অবক্ষেপের উপরের অংশের সন্ধান সিলেট অঞ্চলের আটগ্রাম ও ফেঞ্চুগঞ্জ কূপসমূহের গভীর অন্তর্ভূপৃষ্ঠে (৪,০০০ মিটারের বেশি গভীরে) পাওয়া যায়।

মায়োসিন-প্লায়োসিন যুগের সুরমা গ্রুপ অসঙ্গতভাবে বড়াইল গ্রুপের উপর অধিশায়িত। সুরমা গ্রুপের পুরুত্ব প্রায় ৩,৫০০ থেকে ৪,৫০০ মিটার এবং একান্বয়ী পরিবর্তী বেলেপাথর, কর্দম শিলা পলিপাথর ও কিছু পিন্ডীভূত শিলা দ্বারা গঠিত। এটি বদ্বীপীয় থেকে অগভীর সামুদ্রিক পরিবেশে উপলোপিত বলে সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক মাঠ গবেষণায় দেখা যায় সুরমা গ্রুপের মূল শিলাপিঠ পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলে গভীর সামুদ্রিক ঘনস্রোত অবক্ষেপেও গঠিত হয়। সুরমা গ্রুপ দুটি স্তরসমষ্টিতে বিভক্ত- নিম্নতর অধিকতর বালুময় ভুবন স্তরসমষ্টি এবং উচ্চতর অধিকতর কাদাময় বোকাবিল স্তরসমষ্টি। বোকাবিল ও ভুবন স্তরসমষ্টি উভয়ই নিজেদের মধ্যে বালু ও কাদার অনুপাতে ব্যাপক পার্শ্বিক ফেসিস পরিবর্তন এবং উল্লম্ব প্রকারভেদ প্রদর্শন করে, যা অববাহিকার উপর দিয়ে শিলা ইউনিটসমূহের সহগতিকে জটিল করে তুলেছে। সুরমা অবক্ষেপসমূহে লক্ষণযুক্ত জীবাশ্মের পরিমাণ নগণ্য হওয়ার কারণে এদের কালগত বয়স নির্ণয়ও কষ্টকর। মহীখাতীয় অববাহিকায় খননকৃত সকল কূপ অধিক পুরুত্ববিশিষ্ট হওয়ায় এবং সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে সবচেয়ে প্রকট, সে অঞ্চলের মেরুদন্ড হিসেবে কাজ করায় সুরমা গ্রুপ সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরীয় ইউনিট।

সুরমা গ্রুপ প্লায়োসিন-প্লাইসটোসিন যুগের টিপাম গ্রুপের বিস্তীর্ণ বালুরাশিতে ঢাকা। গ্রুপটি নিচ থেকে ঊর্ধ্বমুখে যথাক্রমে টিপাম বেলেপাথর স্তরসমষ্টি, গিরুজান কাদাস্তর ও ডুপিটিলা স্তরমালায় উপভাজিত। টিপাম বেলেপাথর স্তরসমষ্টি প্রায় ১২০০ থেকে ২৫০০ মিটার পুরু এবং কর্দম শিলার সহযোগে প্রধানত মাঝারি দানার বেলেপাথর দ্বারা গঠিত, যা এর নদী পরিবেশে অবক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। এটি সাম্প্রতিক যুগের বঙ্গীয় পললের প্রায় ১০০ মিটার বালুময়, পলিযুক্ত ও কর্দম অবক্ষেপে আবৃত।

বাংলাদেশের স্তরবিদ্যার উপর গবেষণা খুবই সাদামাটা বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের স্তরীয় উপবিভাজন ও নামকরণ ১৯৩২ সালে পি. ইভানস (Evans) কৃত সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্য আসাম ও এর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিলা অনুক্রমকেই এখনও অনুসরণ করে চলেছে। একটি বদ্বীপীয় থেকে প্রবাহজ পরিবেশে এদের পারস্পরিক সম্বন্ধের কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশের সমগ্র অববাহিকার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে ইভানস প্রতিষ্ঠিত একক সমূহের পারম্পর্য খুবই স্থূল ও অকিঞ্চিৎকর বলেই মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন, ভুবন ও বোকাবিল স্তরসমষ্টির শৈল নির্ণায়ক এত বেশি ব্যক্ত নয় যে এই ইউনিটসমূহ সমগ্র অববাহিকায় সম্প্রসারিত করা যাবে।

অর্থনৈতিক ভূতত্ত্ব  পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদের বাণিজ্যিক মজুত ভূতাত্ত্বিক স্থিতিমাপ (parameter), বিশেষ করে ভূ-গাঠনিক সংযুতিগত স্থাপনা এবং স্তরবিদ্যা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উদাহরণস্বরূপ, প্রাক-ক্যামব্রীয় প্ল্যাটফর্মের মধ্যে গ্রস্ত অববাহিকায় (Graben Basin) পার্মীয় শিলার উপস্থিতির কারণে বিটুমিন কয়লার বড় বড় মজুত বাংলাদেশের কেবল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের বৃহৎ ভান্ডার বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণ এখানে পুরু মায়ো-প্লায়োসিন বেলেপাথরের আধারে গ্যাস ধরে রাখার মতো বলিত কাঠামো বর্তমান রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও পিট, চুনাপাথর, কেলাসিত কঠিন শিলা, ভারী খনিজ, কেওলিনাইট ও কাচবালুসহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্যিক খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সব সম্পদের প্রত্যেকটি সুনির্দিষ্ট ভূতাত্ত্বিক স্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২২টি গ্যাসক্ষেত্রের অর্ধেকই দেশের পূবাঞ্চলীয় অর্ধে অবস্থিত। গ্যাস ভূঅভ্যন্তরের প্রায় ১০০ থেকে ৩৫০০ মিটার নিচে পাওয়া যায়। গ্যাস তৈরি হওয়া অন্যান্য উপাদানের মধ্যে উপযুক্ত গ্যাস ধারক থাকার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল বলিত বলয় বিভাগে অবস্থিত এবং এখানকার প্রতিনতভঙ্গ (anticlinal fold) গ্যাস সঞ্চয়নের অতি উপযুক্ত স্থাপনা ধারক গঠন করে থাকে।। মায়োসিন-প্লায়োসিন সুরমা গ্রুপ শিলাসমূহের বেলেপাথর অতি উত্তম গ্যাস আধার। নিচের উৎস শিলায় সৃষ্ট প্রাকৃতিক গ্যাস স্থাপনা ধারকের মায়ো-প্লায়োসিন যুগের বেলেপাথর আধারে সঞ্চিত হওয়ার জন্য সহজেই ঊর্ধ্বপানে স্থানান্তরিত হয়েছিল।

প্রাক-ক্যামব্রীয় ভিত্তিশিলার উপরে চ্যুতি-বেষ্টিত গ্রস্ত অববাহিকায় পার্মীয় অবক্ষেপ সংঘটনের কারণে রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় দেশের অধিকাংশ বিটুমিন কয়লার মজুত কেন্দ্রীভূত। পার্মীয় ভূতাত্ত্বিক যুগে ঘন গাছপালা ও জলাময় পরিবেশের মতো অনুকূল কয়লা উৎপাদনকারী পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে পার্মীয় অবক্ষেপ কয়লায় সমৃদ্ধ। গ্রস্ত-উপত্যকা অববাহিকাসমূহে কয়লা ভালভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশে এই পরিস্থিতি বিরাজমান।

অগভীর শান্ত ও উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশে চুনাপাথর গঠিত হয়। মধ্য ইয়োসিন যুগে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে এই ধরনের অগভীর, উন্মুক্ত সামুদ্রিক পরিবেশ বিরাজিত ছিল এবং সিলেট চুনাপাথর স্তরসমষ্টি ঐ সময়ে গঠিত হয়। চুনাপাথর তাই সিলেট চুনাপাথর স্তরসমষ্টি গঠিত হওয়ার স্থানসমূহে সীমাবদ্ধ। সিলেট চুনাপাথর স্তরসমষ্টি বগুড়া-রাজশাহী অঞ্চলের অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠে এবং সিলেটের উত্তরাঞ্চলের লালঘাট-ভাঙ্গারহাট অঞ্চলের ভূ-পৃষ্ঠে পাওয়া যায়।

দেশের অনেক অঞ্চলে বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে কাচবালুর সমৃদ্ধ মজুত রয়েছে। বিভিন্ন অপবস্ত্ত ধুয়ে যাওয়ার ফলে বালুতে কোয়ার্টজের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রক্রিয়ার ওপর কাচবালু সংঘটন নির্ভর করে। বালু অধ্যুষিত ডুপিটিলা স্তরসমষ্টির অন্তর্গত কোয়ার্টজ সমৃদ্ধ বালুতে কাচবালুর মজুত পাওয়া যায়। কোয়ার্টজ সমৃদ্ধ বালুর পকেটসমূহ দ্বিতীয় ক্ষয়চক্র ও প্রাক-নির্গমনীয় টিপাম ও প্রাচীনতর বেলেপাথরের পাহাড়সমূহে পাওয়া যায়। তাই কাচবালু মজুতের অবস্থিতি ডুপিটিলা বেলেপাথর স্তরসমষ্টির অবস্থান দ্বারা প্রধানত নিয়ন্ত্রিত।

সারা বিশ্বেই প্রাক-ক্যামব্রীয় ভিত্তিশিলা কঠিন কেলাসিত আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলায় গঠিত। রংপুর ও দিনাজপুরে অগভীর অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠে গ্রানাইটিয় আগ্নেয় ও রূপান্তরিত কঠিন শিলার উপস্থিতির কারণ ঐ অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক স্থিতিশীলতা, যে কারণে প্রাক-ক্যামব্রীয় ভিত্তিস্তর শিলা (basement rock) খুব গভীরে অবনমিত না হয়ে ভূ-পৃষ্ঠের খুব কাছে অবস্থান করছে।  [বদরুল ইমাম]