বাংলাদেশের ভূগোল

বাংলাদেশের ভূগোল  বাংলাদেশের ভূখন্ডগত বিস্তৃতি ১৪৭, ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার, যা গ্রীসের চাইতে সামান্য বড়। এর ভৌগোলিক অবস্থান ২০°৩৪´ উ থেকে ২৬°৩৮´ উ অক্ষাংশ এবং ৮৮°০১´ পূ থেকে ৯২°৪১´ পূ দ্রাঘিমাংশে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এর সর্বোচ্চ বিস্তৃতি প্রায় ৪৪০ কিমি এবং উত্তর উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্বে সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ৭৬০ কিমি। বাংলাদেশের পশ্চিমে, উত্তরে, পুর্বে ও দক্ষিণ পূর্বে ঘিরে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মায়ানমার সীমান্ত। বাংলাদেশের সর্বমোট ভূসীমান্তের দৈর্ঘ্য ২৪০০ কিমি, যার ৯২% সীমান্ত ভারতের সাথে বাকি, ৮% সীমান্ত মায়ানমারের সাথে। দেশটির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় সীমারেখা। যদিও বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে একটি ক্ষুদ্র দেশ, এর উপকূলীয় সীমারেখার দৈর্ঘ্য ৪৮৩ কিলোমিটারের অধিক। বাংলাদেশের ভূখন্ডগত সমুদ্রসীমা ১২ নটিক্যাল মাইল (২২.২২ কিমি) এবং উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০.৪০ কিমি) পর্যন্ত বিস্তৃত এর অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা। বঙ্গোপসাগর তার ঘূর্ণিঝড়সমূহের জন্য বহুল পরিচিত। এই ঝড় সমুদ্রের পানিকে সমুদ্রতীর হতে দূরবর্তী দ্বীপসমূহের উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে ফেলে, কখনও কখনও তা বন্যারও সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের বিশাল এলাকা জুড়েই জলবেষ্টিত বদ্বীপ বনাঞ্চল পরিশোভিত যা,  সুন্দরবন নামে পরিচিত; এটাই পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল।

বাংলাদেশ ৬টি মূল প্রশাসনিক অঞ্চল সমন্বয়ে গঠিত, যা বিভাগ নামে পরিচিত। এগুলো হলো বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী এবং সিলেট বিভাগ। এসকল বিভাগের অধীনে রয়েছে ৬৪টি জেলা এবং এই ৬৪টি জেলাকে বিভক্ত করা হয়েছে মোট ৪৯৬টি থানা/উপজেলায়। বাংলাদেশের ৯৫ থেকে ১১৯টি  ছিটমহল রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানায়। এসব ছিটমহল এলাকার পরিসীমা ০.৪ হেক্টর থেকে ২০.৭২ বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।

জনসংখ্যা  গড় জনসংখ্যা ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম স্থানে রয়েছে এবং জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম দেশ। সর্বমোট জনসংখ্যা ১২ কোটি ৯২ লক্ষ ৫০ হাজার (২০০১) এবং এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮৭৬ জন মানুষ বাস করে। জনসংখ্যার লৈঙ্গিক অনুপাত, ১০০:১০৪ (নারী:পুরুষ)। বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৮ (২০০১ আদমশুমারি পর্যন্ত) এবং সাত বছর বয়সের উপর জনসংখ্যার সাক্ষরতা হার ৩২.৪০% (২০০১)। বাংলাদেশে চারটি জাতি গোষ্ঠীর মানুষের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এরা হলো দ্রাবিড়, আদি অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয় এবং বাঙালি। জনসংখ্যার দ্রাবিড়ীয় জাতির উপাদানের প্রতিনিধিত্ব করছে মূলত ওরাত্তঁগণ। এরা ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মানবগোষ্ঠী। বাংলাদেশে এই গোষ্ঠীর মাত্র কয়েক হাজার মানুষ রয়েছেল-যারা দেশের ক্ষুদ্রতম জাতিগোষ্ঠী। সিলেটের চা বাগানের শ্রমিক জনগোষ্ঠীতে খাসিয়ারা রয়েছে যারা আদি অস্ট্রেলীয় জাতি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীভুক্ত মানুষ শিলং মালভূমির দক্ষিণ অংশে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং মধুপুর বনাঞ্চলে বসবাস করছে। এদের সংখ্যা ৫,০০,০০০-৬,০০,০০০। চাকমা, ত্রিপুরা, গারো, মুরং এবং মগ বাংলাদেশের মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর প্রধান জাতিসমূহ। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি পৃথক জাতি রয়েছে। এরা আবার প্রায় একশত পৃথক উপদলে বিভক্ত। বাঙালি এদেশে বসবাসকারী জাতিসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ। দেশের সর্বমোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৬.৬১ ভাগই বাঙালি (জানুয়ারি, ২০০১)। এই গোষ্ঠীটি অ-উপজাতীয় এবং উৎপত্তিগত দিক থেকে শঙ্কর জাতিগোষ্ঠী। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮৮% মুসলিম, ১১% হিন্দু এবং অবশিষ্টদের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং সর্বপ্রাণবাদীরা।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাপেক্ষা কম শহরায়িত এলাকাসমূহের একটি। এখানে শহুরে জনসংখ্যার শতকরা হার ২০ ভাগ যেখানে গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা হার ৮০ ভাগ। এখানে মহানগরের সংখ্যা মাত্র ৪টি (সিটি কর্পোরেশন) যদিও এখানে শতাধিক বিভিন্ন আকারের শহর এলাকা রয়েছে। ঢাকা দেশের রাজধানী এবং বৃহত্তম মহানগর। এ এলাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৯৯ লক্ষ। চট্টগ্রাম দেশের বন্দর নগরী, দ্বিতীয় সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মহানগর; এর জনসংখ্যা ৩২ লক্ষ। এই মহানগরীতে বেশকিছু শিল্প এলাকা গড়ে উঠেছে। খুলনা দেশের দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত বাণিজ্য ও শিল্প কেন্দ্র; মংলা বন্দর এবং দৌলতপুর, খালিশপুরের শিল্প কারখানাগুলো এখানকার জনসংখ্যাকে ১২ লক্ষতে বৃদ্ধি করেছে (১৯৯৫)। দেশের শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত রাজশাহী দেশের ৪র্থ বৃহত্তম নগর, জনসংখ্যা ৬ লক্ষ।

ভূপ্রকৃতি বাংলাদেশ তিনটি বৃহৎ নদীপ্রণালী- গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার নিম্নতম প্রবাহ অঞ্চলে অবস্থিত এবং এর ভূখন্ডের প্রায় অর্ধাংশই ১০ মিটার সমোন্নতি রেখার নিচে। যুগপৎভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে উচ্চতা এবং ভূপ্রকৃতির উপর ভিত্তি করে দেশটির ভূমিকে তিনটি প্রধান ভূ-অঞ্চলে বিভক্ত করা যেতে পারে: টারশিয়ারি পাহাড় অঞ্চল (বর্তমান সময় থেকে ৬৬০ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ বৎসর পূর্বে), প্লাইসটোসিন উচ্চভূমি (বর্তমান সময় থেকে ২০ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ বৎসর পূর্বে গঠিত) এবং নবীন সমভূমি (এক লক্ষ বৎসর পূর্বে এর গঠন শুরু হয়, বর্তমানে সে গঠন প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল)। বর্ষাকালীন ভারি বৃষ্টিপাত এবং দেশটির অধিকাংশ এলাকার সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে নিম্ন উচ্চতা দেশটিকে প্রতি বৎসর বন্যার মুখোমুখি করে।

কোয়াটারনারি পলল (২০ লক্ষ বৎসর পূর্বে শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত সম্প্রসারিত)-এর সঞ্চয় ঘটেছে প্রধানত গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) এবং মেঘনা নদী ও তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে। বাংলাদেশের তিন চতুর্থাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই পলল ভূমি। দেশের কেন্দ্রীয় উত্তরাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত বিশাল পলল সমভূমির ভূপ্রকৃতি এবং নিষ্কাশন ধরনে সাম্প্রতিক কালে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। কোয়াটারনারি পললের সঞ্চয় ভূকাঠামোগত কর্মকান্ডের দ্বারা প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত ছিল। গত ২০০ বৎসরে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পূর্বাভিমুখী গতি পরিবর্তন এবং সাথে সাথে ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিমাভিমুখী পরিবর্তন সাম্প্রতিক কালে ভূত্বকের বিরাট এলাকাব্যাপী বিচলন (epeirogenic movement)-এর প্রমাণ। পাহাড় এবং টিলাভূমিগুলির অবস্থান শিলং মালভূমির দক্ষিণ অংশের একটি সংকীর্ণ দীর্ঘ এলাকা জুড়ে। সিলেট জেলার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশে এবং দেশের দক্ষিণপূর্বের চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্য এবং মায়ানমার ইউনিয়নের সাথে সীমান্ত রচনা করেছে।

ভূপ্রকৃতি অনুসারে বাংলাদেশকে পাঁচটি পৃথক অঞ্চলে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যার প্রত্যেকটি অঞ্চলেরই রয়েছে নিজস্ব পৃথক বৈশিষ্ট্যসমূহ। ভূপ্রকৃতির বিস্তারিত ব্যাখ্যায় সমগ্র দেশটিকে ২৪টি উপ-অঞ্চল এবং ৫৪টি একক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান অঞ্চল এবং উপ-অঞ্চলগুলি হলো: (১) পুরাতন হিমালয় পাদদেশীয় সমভূমি, (২) তিস্তা প্লাবনভূমি, (৩) পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি, (৪) ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্লাবনভূমি, (৫) হাওর অববাহিকা, (৬) সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি, (৭) মেঘনা প্লাবনভূমি- (ক) মধ্য মেঘনা প্লাবনভূমি, (খ) লোয়ার মেঘনা প্লাবনভূমি, (গ) পুরাতন মেঘনা মোহনা প্লাবনভূমি (ঘ) নবীন মেঘনা মোহনা প্লাবনভূমি, (৮) গাঙ্গেয় প্লাবনভূমি, (৯) গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি, (১০) সুন্দরবন, (১১) নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা, (১২) আড়িয়াল বিল, (১৩) গোপালগঞ্জ-খুলনা পিট অববাহিকা, (১৪) চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি, (১৫) উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাদদেশীয় সমভূমি, (১৬) প্লাইসটোসিন সোপানসমূহ- (ক) বরেন্দ্রভূমি, (খ) মধুপুর গড় (গ) তিপারা পৃষ্ঠ, (১৭) উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চল- (ক) স্বল্প উচ্চতাবিশিষ্ট পাহাড়সারি (ডুপি টিলা ও ডিহিং স্তরসমষ্টি), (খ) পর্বতসারি (সুরমা ও টিপাম স্তরসমষ্টি)।

পাদদেশীয় সমভূমি  পাহাড়ের পাদদেশে ঢালু হয়ে নেমে আসা সমভূমিই পাদদেশীয় সমভূমি, পাহাড় থেকে বয়ে আসা নদী বা স্রোতধারার মাধ্যমে বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে পলিকণা এখানে এসে সঞ্চিত হয়। হিমালয় পাদদেশীয় সমভূমির একটি অংশ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত - দিনাজপুর অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত। এই পাদদেশীয় ভূমি গঠিত হয়েছিল প্লাইসটোসিন যুগের শেষ পর্যায়ে বা হলোসিন যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে, তবে এ ভূমি মধুপুর কর্দমের তুলনায় নবীন।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি  গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত থেকে মেঘনা নদীর নিম্নাভিমুখে মধুপুর গড়ের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি মূলত প্রশস্ত শৈলশিরা (Ridges) এবং নিম্নভূমি দ্বারা গঠিত। নিম্নভূমি অঞ্চল সাধারণভাবে এক মিটারের অধিক গভীর বন্যা প্লাবিত হয়, কিন্তু তুলনামূলক উচ্চভূমি অঞ্চলে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে অগভীর বন্যা দেখা দেয়।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্লাবনভূমি  এই যুগ্ম নামটি মূলত বৃহৎ ব্রহ্মপুত্র নদীর ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়, যেহেতু যমুনা নদী খাতটি অপেক্ষাকৃত নতুন এবং এই নতুন গতিপথটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে স্পষ্টতই পৃথক। ১৭৮৭ সালের পূর্বে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পূর্ব দিক থেকে বর্তমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ অনুসরণ করত। ঐ বৎসর সম্ভবত একটি মারাত্মক বন্যার প্রভাবে ঝিনাই ও কোনাই নদীর দক্ষিণাভিমুখী গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে প্রশস্ত ও বিনুনি আকৃতির যমুনা নদীখাতের সৃষ্টি করে। ধারণা করা হয়, গতিপথের এই পরিবর্তন সম্পন্ন হয়েছিল ১৮৩০ সালের মধ্যে। দুটি বিশাল প্লাইসটোসিন ভূখন্ড বরেন্দ্রভূমি ও মধুপুর গড়ের ঊন্মেষের ফলে দুটি ভূখন্ডের মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে ভূঅবনমনের সৃষ্টি হয় যা একটি ভূ-উপত্যকার সৃষ্টি করে। এইটিই ব্রহ্মপুত্রের নতুন গতিপথ হিসেবে পরিচিত যা যমুনা নামে অভিহিত।

প্রশস্ত উচ্চ গঙ্গা প্লাবনভূমি দেশের পশ্চিম সীমান্তবর্তী গোদাগাড়ি উপজেলার প্রেমতলী থেকে বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ প্রান্ত এবং পূর্বে সুজানগর উপজেলা (পাবনা) পর্যন্ত বিস্তৃত, পূর্বপ্রান্তে গঙ্গা প্লাবনভূমি ঢালু হয়ে যমুনা প্লাবনভূমিতে মিশেছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী তার গতিপথে মেঘনা প্লাবনভূমি গড়ে তুলেছে, যার মধ্যে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট উর্বর মেঘনা- শীতলক্ষ্যা দোয়াব অন্তর্ভুক্ত। তিতাস নদী এবং এর শাখা-প্রশাখা মেঘনার দিয়ারা ও চরাঞ্চলসমূহ, বিশেষ করে ভৈরববাজার ও দাউদকান্দির মধ্যে অবস্থিত দিয়ারা ও চরগুলি প্লাবনভূমিকে সমৃদ্ধ করেছে। মেঘনা নদীর বিশাল প্লাবনভূমি প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে উঠেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন গতিপথ অঞ্চলে। হাওর অববাহিকা মূলত একটি বিশাল শান্ত নিম্নভূমির জলাভূমি, যা পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি, উত্তরে মেঘালয় মালভূমির পর্বত পাদদেশীয় অঞ্চল এবং পূর্বে সিলেট সমভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত। পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণ উভয় দিকে এর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১১৩ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। অসংখ্য বিল এবং বিশাল হাওরবহুল এই পিরিচাকার এলাকার আয়তন ৭.২৫০ বর্গ কিমি। ধারণা করা হয়, বর্তমানের এই পিরিচ-আকার বিশাল জলমগ্ন এলাকা মধুপুর গড়ের ঊন্মেষের ঘটনার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

বদ্বীপ মূলত একটি নদীর অনুপ্রস্থভাবে অতিক্রম করা ধারা-উপধারা বাহিত পলিমাটি সঞ্চিত ভূমি, যা আকৃতিতে কমবেশি ত্রিভুজাকার প্রান্তিক প্লাবনভূমি। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বদ্বীপ। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই বদ্বীপের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৪৬,৬২০ কিমি, যা সমগ্রদেশের মোট এলাকার মোটামুটি এক তৃতীয়াংশের সামান্য কিছু কম (প্রায় ৩২%)। এই এলাকার মধ্যে নদীঅঞ্চল অন্তর্ভুক্ত। গঙ্গা ও পদ্মার উপর দক্ষিণ দিক বরাবর অংকিত কল্পিত রেখার দক্ষিণপূর্বের ফেনী নদীর নিম্নতর গতিপথ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ভূপ্রকৃতিগতভাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) এবং মেঘনা নদীর বদ্বীপের অন্তর্গত। এই বিশাল বদ্বীপভূমিকে আরও পাঁচটি উপবিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, যেমন মৃত প্রায় বদ্বীপ, কেন্দ্রীয় বদ্বীপ অববাহিকা সমূহ, অপরিণত বদ্বীপ, পরিণত বদ্বীপ, এবং সক্রিয় বদ্বীপ। গঙ্গানদী এ পর্যায়ে বদ্বীপটির প্রধান নির্মাতা এবং বদ্বীপটির প্রায় চার পঞ্চমাংশ পলি সঞ্চয়ের উৎস।

প্লাইসটোসিন উচ্চভূমি কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড় এবং সংলগ্ন পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে মোটামুটিভাবে ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগের মধ্য দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। মেঘনা ও যমুনা নদীপ্রণালী প্লাইসটোসিন উচ্চভূমিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছে, যার ফলে তিনটি উচ্চভূমি খন্ডের উদ্ভব ঘটেছে: বরেন্দ্রভূমি, মধুপুর গড় এবং তিপারা পৃষ্ঠ। প্লাইসটোসিন উচ্চভূমির চূড়ান্ত পশ্চিম সীমা নির্ধারণ করেছে গঙ্গা এবং এর দক্ষিণসীমা নির্ধারণ করেছে যমুনার প্রধান দুটি শাখা বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী। রাজশাহী বিভাগের সর্বউত্তরের প্লাইসটোসিন উচ্চভূমির প্রান্তরেখা হিমালয় পাদদেশীয় ভূমির সাথে মিশেছে এবং ময়মনসিংহ জেলায় এই উচ্চভূমির ঢাল পাললিক সমভূমিতে গিয়ে মিশেছে। বাংলাদেশের ভূখন্ডের ১০% এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে প্লাইসটোসিন উচ্চভূমি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা ১৫ মিটারের উপরে।

পূর্ব এবং উত্তরের সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের পর্বত এলাকার প্রতিনিধিত্বকারী অঞ্চল, যাকে দুটি প্রধান উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়: ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং খ) শিলং অধিত্যকার পার্বত্য পাদদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থাৎ দেশের একমাত্র বিস্তৃত পর্বত এলাকাটি পাহাড়, টিলা, উপত্যকা এবং বনাঞ্চল সমৃদ্ধ। এ এলাকা বাংলাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূপ্রকৃতির। অঞ্চলটি দেশের দক্ষিণপূর্ব অংশে অবস্থিত। দক্ষিণপূর্বে মায়ানমার সীমান্ত, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত এবং পূর্বে মিজোরাম সীমান্ত দ্বারা পরিবেষ্টিত এই বিস্তৃত পার্বত্য এলাকাটি সাধারণত পাহাড়ের ব্যাপ্তি এবং নদী উপত্যকা অনুদৈর্ঘ্য বরাবর শ্রেণিবদ্ধ। পার্বত্য এলাকার দক্ষিণপূর্ব কোণে অবস্থিত মওদক মুয়াল হলো সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, এর উচ্চতা ১০০৩ মিটার। সমুদ্র উপকূলীয় সমভূমি আংশিক বালুকাময় এবং আংশিক নোনা কাদামাটি দ্বারা গঠিত। ফেনী নদী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই উপকূলীয় সমভূমির প্রশস্ততা স্থানভেদে ভিন্ন। প্রশস্ততার পরিসীমা ১ থেকে ১৬ কিমি পর্যন্ত। এ অঞ্চলে রয়েছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ কিছু সংখ্যক সামুদ্রিক দ্বীপ। পার্বত্য চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় অংশে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি কৃত্রিম হ্রদ যা কাপ্তাই হ্রদ নামে পরিচিত। শুষ্ক মৌসুমে এ হ্রদের বিস্তৃতির আয়তন ৭৬৮ বর্গ কিমি এবং বর্ষা মৌসুমে এর আয়তন দাঁড়ায় ১০৩৬ বর্গ কিমি।

শিলং মালভূমির পাদদেশ এলাকাকে পশ্চিম থেকে পূর্বে তিনটি প্রধান ভূগাঠনিক (tectonic) উপ-একক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়: গারো পাহাড়, খাসিয়া পাহাড় এবং জৈন্তিয়া পাহাড়, যার প্রায় সবটাই ভারতের ভূখন্ড জুড়ে রয়েছে। এই উচ্চ পাহাড়শ্রেণীর দক্ষিণ প্রান্তের পাদদেশীয় ভূমির পাহাড় ও টিলাময় একটি সংকীর্ণ অথচ দীর্ঘ এলাকাই শুধুমাত্র বাংলাদেশ ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত।

জলতত্ত্ব  গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-মেঘনা এবং এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী বাংলাদেশে নিষ্কাশন প্রণালীর ধমনীর মতো কাজ করছে। কর্ণফুলি, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, ফেনী, নাফ নদী এবং তাদের পানি প্রবাহ সরবরাহকারী নদীখাতসমূহ চট্টগ্রাম জেলা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পার্বত্য এলাকার পানি সরাসরি বঙ্গোপসাগরে নিষ্কাশিত করে। পার্বত্য এলাকার সর্ব পশ্চিমাঞ্চল থেকে উৎপন্ন বহুসংখ্যক স্রোতধারা সরাসরি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। দেশজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদনদী বাংলাদেশের অহংকার। এদের মধ্যে গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলি এবং তিস্তা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এদের শাখানদী ও উপনদীর সংখ্যা ৭০০-র মতো। বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রবাহিত এ সকল নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ২৪,১৪০ কিমি। ১২০ কিমি দীর্ঘ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। গঙ্গা,  ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা এই তিনটি বৃহৎ নদীর মিলিত নিষ্কাশন অববাহিকার আয়তন প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। নদীগুলি বঙ্গোপসাগরে বয়ে নিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণ পলি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্রতিদিন ১.২০০.০০০ টন পলি বহন করে আনে। প্রতিবৎসর গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী প্রণালীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বয়ে আনা পলির পরিমাণ প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন।

জলবায়ু  গ্রীষ্মমন্ডলীয় মৌসুমি বায়ু দ্বারা এ দেশের জলবায়ু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। সমগ্র বৎসরকে স্পষ্টতই চারটি প্রধান ঋতুতে বিভক্ত করা হয়-  ক) প্রাক-বর্ষা মৌসুম, (খ) বর্ষামৌসুম, (গ) বর্ষা উত্তর মৌসুম এবং (ঘ) শুষ্ক মৌসুম (শীতকাল)। প্রাকবর্ষা মৌসুম মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বিস্তৃ্ত। এ সময়ে তাপমাত্রা এবং বাষ্পীভবনের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, কখনও কখনও প্রচন্ড ঝড়ঝঞ্ঝা বিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টি সংঘটিত হয়। উপকূলীয় এলাকায় ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টিতে গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়সমূহ দায়ী। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত কাল বর্ষা মৌসুম। সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা এবং মেঘাচ্ছন্নতা মৌসুমের বৈশিষ্ট্য। বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি বৃষ্টিপাত এই সময়ে ঘটে। অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত কাল বর্ষাউত্তর মৌসুম। এ মৌসুম মূলত সূর্যালোকোজ্জ্বল, তপ্ত এবং আর্দ্র, তবে রাত্রিকালে প্রচুর শিশিরপাত ঘটে। এসময়ে আকস্মিক ঝঞ্ঝা বিদ্যুৎসহ ঝড় বৃষ্টি ঘটে থাকে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়গুলি উপকূলীয় এলাকায় প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত কাল শুষ্কমৌসুম তুলনামূলকভাবে শীতল, শুষ্ক এবং সূর্যকরোজ্জ্বল। এ সময় সাধারণভাবে স্বল্প শীতকালীন বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে, তবে তা অনিশ্চিত (যদিও এ সময়ে বৃষ্টিপাত কৃষিকাজের জন্য উপকারী)।

বৎসর ব্যাপী তাপমাত্রা বিতরণ অনুসারে বাংলাদেশে স্পষ্টতই দুটি পৃথক ঋতু পরিদৃষ্ট হয়, একটি শীতল এবং একটি উষ্ণ মৌসুম। শীতল মৌসুমটি স্থায়ী হয় নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এবং উষ্ণমৌসুম স্থায়ী হয় মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারি একটি প্রান্তবর্তী মাস, পরবর্তী মাসসমূহ মার্চ, এপ্রিল এবং মে-তে উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে। সর্বত্রই গড় বাৎসরিক তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াসের মতো অথচ মাসিক তাপমাত্রার গড় পরিসীমা জানুয়ারিতে ১৮°সে এবং এপ্রিল-মে তে তা ৩০°সে-এ দাঁড়ায়। মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার ব্যাপ্তিটি ৪০°সে থেকে ৪৩°সে-এর মধ্যে থাকে; উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি এই পরিসীমাটি আরও সংকীর্ণতর। সমগ্র দেশ জুড়ে তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ঋতুগত বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত সর্বোচ্চ প্রাক বর্ষা মৌসুম তাপমাত্রা দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ঘটে থাকে। উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় শীত মৌসুমের ব্যাপ্তি ৩৫-৪০ দিনের, এসময়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫°সে-এর নিচে থাকে। সর্ব উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এ শীতমৌসুমের ব্যাপ্তি ১০০ দিনের মতো।

বর্ষা মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাত অঞ্চলভেদে ভিন্নতর চিত্র তুলে ধরে। এই সময়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহ রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া এবং যশোরে গড় বৃষ্টিপাতের সীমা ৮৯০ মিমি-এর মতো এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব অংশে এ মাত্রা ২,০৩০ মিমি-এর উপরে। দেশের সর্ব উত্তরপূর্বে শিলং অধিত্যকার পর্বত পাদদেশীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫০০০ মিমি-এর উপরে। গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টি (যা বর্ষা মৌসুম হিসেবে পরিচিত) ছাড়াও ভূমধ্যসাগর থেকে সৃষ্ট শীতকালীন নিম্নচাপ এবং এপ্রিল-মে মাসে সংঘটিত বহুল পরিচিত কালবৈশাখী (বৈশাখের দুর্যোগ, মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে-তে সংঘটিত হয়) বাৎসরিক বৃষ্টিপাতে ভূমিকা রাখে। কালবৈশাখীর সময় বৃষ্টিপাতে অঞ্চলগত ভিন্নতা রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে এর পরিমাণ ২৫০ মিমি-এর মতো এবং পূর্বাঞ্চলে এ মাত্রা ৬৩৫ মিমি। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বিস্তৃত শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫০ মিমি পর্যন্ত। ডিসেম্বর মাসে এ মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে।

নভেম্বর থেকে মার্চে বৃষ্টিপাত  হ্রাস পেতে থাকে এবং এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত মৌসুমে। বাৎসরিক বৃষ্টিপাত পূর্ব থেকে পশ্চিমে হ্রাস পায়। জুন এবং জুলাই-এ সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে নিম্নতম বায়ুমন্ডলীয় চাপ ঘটে থাকে। শীত মৌসুমে প্রধানত উত্তর এবং উত্তরপূর্ব দিক থেকে বাতাস  প্রবাহিত হয়। উত্তর ও কেন্দ্রীয় এলাকায় ঘণ্টায় ১.৬১ থেকে ৩.২২ কিমি গতিতে শান্ত বায়ুপ্রবাহ দেখা দেয় এবং উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় এ মাত্রা ঘণ্টায় ৩.২২ থেকে ৬.৪৪ কিমি।

গ্রীষ্মের প্রাথমিক পর্যায়ে (এপ্রিল-মে) এবং বর্ষামৌসুমের শেষভাগে (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) প্রায়শই অতি উচ্চমাত্রার তীব্রতা সম্পন্ন ঝড় সংঘটিত হয়। এই সব ঝড় ঘণ্টায় ১৬০ কিমির ঊর্ধ্বের গতিবেগ সম্পন্ন বাতাস সৃষ্টি করতে পারে; বঙ্গোপসাগরে পানিকে ফুসে উঠতে সাহায্য করে ৬ মিটার পর্যন্ত উচ্চ জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে যা প্রচন্ড শক্তি নিয়ে উপকূলীয় এলাকায় ও সমুদ্র থেকে দূরবর্তী দ্বীপসমূহে আছড়ে পড়ে ঐ অঞ্চলকে প্লাবিত করে। এর ফলে জীবন ও সম্পদের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। যুগপৎভাবে উষ্ণতম সময়ে অর্থাৎ প্রাকবর্ষা মাসসমূহে মারাত্মক বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টি-কালবৈশাখী প্রধানত ঢাকা, ফরিদপুর এবং পাবনা জেলায় সংঘটিত হয়। এ ধরনের বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টির বৈশিষ্ট্য হলো বায়ু প্রবাহের দিকের আকস্মিক পরিবর্তন, তাপমাত্রার দ্রুত পতন এবং ১৫০ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসের গতিবেগ। বৃষ্টিপাতের সীমা সামান্য কয়েক মিমি থেকে এ পর্যন্ত সর্বাধিক ৫২৬ মিমি রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৮৩ সালের ৩০ এপ্রিল নোয়াখালীতে। শিলাবৃষ্টিও ঘটে থাকে এবং প্রায়শই তা প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে।

ঢাকায় দিনের দৈর্ঘ্য ডিসেম্বরে যেখানে ১০.৭ ঘণ্টা, জুন মাসে তা ১৩.৬ ঘণ্টায় দাঁড়ায়। একইভাবে দিবাভাগে সূর্যালোক থাকে বর্ষা মৌসুমে দিনপ্রতি ৫.৪-৫.৮ ঘণ্টা, শীতমৌসুম এবং প্রাকবর্ষা মৌসুমে তা ৮.৫-৯.১ ঘণ্টায় পৌঁছায়। এক্ষেত্রে বৎসর জুড়ে সময়ভেদে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই চিত্রটি মোটামুটিভাবে সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। বর্ষা মৌসুমে দেশের পূর্ব সীমান্ত এলাকায় অন্যান্য এলাকার তুলনায় দিনপ্রতি প্রায় ১ ঘণ্টা কম সূর্যালোক থাকে এবং শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় দিনপ্রতি ১ ঘণ্টা অধিক সূর্যালোক থাকে।  [মাসুদ হাসান চৌধুরী]

আরও দেখুন ভূ-প্রকৃতি; জলবায়ু; নদী

গ্রন্থপঞ্জি  Haroun Er Rashid, Geography of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1991; FH Khan, Geology of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1991; Klaus-Ulrich Reimann, Geology of Bangladesh, Gebrüder Borntraeger, Berlin-Stuttgart, 1993; Hugh Brammer, The Geography of the Soils of Bangladesh, University Press Limited, Dhaka, 1996; রফিক আহমেদ, আবহাওয়া ও জলবায়ুবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ, ১৯৯৭; Bangladesh Bureau of Statistics (BBS), 1997 Statistical Year Book of Bangladesh, BBS, Dhaka, 1998.