বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিরসরাই থেকে ১০ কিলোমিটার এবং বন্দরনগরী বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফেনীর সোনাগাজী এলাকা জুড়ে প্রায় ৩০ হাজার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটি নির্মিত হচ্ছে সাগর পাড়ে ইছাখালী, চরশরৎ, চর মোশাররফ এবং সাধুর চর এলাকায়। বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বারে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির এক মহাজংশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন) হবে একটি অত্যাধুনিক শিল্পনগরী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্মাণ করবে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর অন্যতম। দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে তন্মধ্যে অগ্রাধিকার হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। প্রথমে মিরসরাই ইকোনমিক জোন হিসেবে কার্যক্রম শুরু হলেও এর সঙ্গে সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী অর্থনৈতিক অঞ্চল যুক্ত হয়ে বিশাল এলাকা জুড়ে পরিব্যাপ্ত তিনটি জোনকে একসঙ্গে নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়তাকিয়া থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পশ্চিমে সাগর পাড়ে গড়ে ওঠা সমুদ্রবন্দর এবং গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সকল ধরনের সুবিধাসহ বৃহৎ এই শিল্পনগরের সাথে মহাসড়ক, নদী, সমুদ্র ও রেলপথে সংযোগের অপূর্ব সুযোগ রয়েছে।

তৈরি সম্পন্ন হলে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। শুরুতে ৫ লাখ কর্মসংস্থানের টার্গেট থাকলেও অর্থনৈতিক অঞ্চল ৩০ হাজার একরে সম্প্রসারিত হলে সেখানে কমপক্ষে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে দেশের অন্যান্য জেলার মানুষও এই জোনে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সুযোগ পাবে। অবহেলিত এক চরাঞ্চল পরিণত হয়েছে শিল্পাঞ্চলে। স্থানীয়রাও এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মচারীর আবাসনের কথা চিন্তা করে গড়ে তুলছে নানা ধরনের বাড়িঘর। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ায় বাঁধ ও পর্যাপ্ত স্লুইস গেট নির্মিত হওয়ায় এখানে এখন আর সমুদ্রের পানি প্রবেশ করে না।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে নির্মিত প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়ক দিয়ে সংযুক্ত নগরীর প্রবেশদ্বার বড়তাকিয়া হওয়ায় বড়তাকিয়া রেলস্টেশনটিও আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে যাত্রী সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি নির্মিত হবে পণ্য পরিবহন ও সংরক্ষণের ইয়ার্ড। আমদানি রফতানির সহজ সুবিধার বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে শিল্প-কারখানা ছাড়াও মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ঘেঁষে প্রকৃতির অপার দান বঙ্গোপসাগর উপকূলভাগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করা হবে কনটেইনার বন্দর। হবে ৪০ হাজার টন ক্ষমতার জাহাজ বার্থিং করার মতো সমুদ্রবন্দর। শিল্পাঞ্চলকে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে মিরসরাই এবং সীতাকুণ্ডের মাঝামাঝি এলাকায় নির্মিত হবে মাঝারি আকারের একটি বন্দর। এছাড়া ছোটখাটো একটি বিমানবন্দরও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। গড়ে উঠবে উপশহর, বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র। শিল্পনগর থেকে বন্দরনগরীতে কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সুপার ডাইক কাম মেরিন ড্রাইভওয়ের সাথে যুক্ত হবে। তা ছাড়া শিল্পনগরের কাছেই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং রেলপথ।নোয়াখালী-চট্টগ্রাম বাইপাস মহাসড়কে যুক্ত হবে। ভবিষ্যতে পাশেই নির্মিত হবে হাইস্পিড রেললাইন। সবমিলিয়ে এ শিল্পনগর দেশের আধুনিক অর্থনৈতিক হাব বা প্রাণকেন্দ্রে রূপ নিচ্ছে। একই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর প্রকৃতি, শক্তি ব্যবস্থা, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে মিলে দেশের প্রথম ‘সবুজ’ বা ইকো শিল্পনগরী।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সুবিধা পেতে সহজ হবে। শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগকারীদের অবকাঠামো সুবিধা হিসেবে থাকবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গ্যাস ও পানির সংযোগ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি শোধনাগার, আবাসন, হাসপাতাল, মেরিন ড্রাইভ, ট্যুরিজম পার্ক, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসনিক ভবন এবং আবাসিক অঞ্চলের মতো সামাজিক অবকাঠামো। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার সামুদ্রিক বেড়িবাঁধ, ২৩০ কেভিএ গ্রিড স্টেশন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৮টি কালভার্ট, দুই লেনের ১০ কিলোমিটার সড়ক এবং ১৭ কিলোমিটার গ্যাস পাইপ লাইন নির্মিত হয়েছে।

যে সকল প্রতিষ্ঠান এ শিল্পনগরে ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করছে তার মধ্যে রয়েছে জাপানের বিখ্যাত নিপ্পন স্টিল, সজিত কর্পোরেশন, ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস, চায়না জিনদুন গ্রুপ এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পগ্রুপগুলো।

বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অধীনে এই জোনে ১১৫০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে ইপিজেড। চট্টগ্রাম ইপিজেডে মোট ভূমির পরিমাণ ৪৫৩ একর। মিরসরাইতে ভূমি পাওয়া গেছে প্রায় তিনগুণের কাছাকাছি। সারাদেশের আটটি ইপিজেডের ভূমির পরিমাণ মোট ২৪শ একর। আর শুধু মিরসরাইতে পাওয়া গেছে ১১৫০ একর। এটি হবে বেপজার অধীনে সবচেয়ে বড় শিল্পজোন।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে উদ্যোক্তারা একক অথবা যৌথ উদ্যোগে গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার এবং তার সহায়ক শিল্প, কৃষি পণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য, ইস্পাত ও লোহাজাত শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, সোলার পার্ক, রাসায়নিক দ্রব্য, বৈদ্যুতিক ও ইলেট্রনিকস সরঞ্জাম, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং (অটো পার্টস এবং সাইকেল), ওষুধ, ইন্টিগ্রেটেড টেক্সটাইল, কনটেইনার ম্যানুফ্যাকচারিং, শিপ বিল্ডিং, ভোজ্যতেল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, খাদ্য ও পানীয়, কাগজ, প্লাস্টিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পেইন্টস, মোটরবাইক, মোটরযান বা অটোমোবাইল, আইটি, বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগ ও শিল্প, কল-কারখানা স্থাপন করছে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অবস্থান ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এবং সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ায় এটি বাংলাদেশকে বড় পরিসরে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং শিল্পায়নের ফলে গ্রামের মানুষ শহরাঞ্চলের দিকে আসাটা এখন দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ফলে শহর অঞ্চলগুলোতে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৬ হাজার ৪০০ জন মানুষ বসবাস করছে। শহরে জনসংখ্যা বাড়লে কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সার্বজনীন পরিষেবার পাশাপাশি আবাসন, পরিবহন, জ্বালানি ও অন্যান্য অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। নগরায়নের সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য একটি অত্যাধুনিক শিল্পনগর হতে পারে সঠিক সমাধান। যা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে এবং উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটি জীবনমান উন্নয়নের অন্যান্য উপায় ব্যবহার করে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিকগুলোর সাথে মিলে বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করবে।

অত্যাধুনিক শিল্পনগরগুলোতে ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) প্লাটফর্ম ব্যবহার করে শহরের অবকাঠামো পর্যবেক্ষণ যেমন, ট্র্যাফিক, পার্কিং, পানি এমনকি বায়ু দূষণ ইত্যাদি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হবে ভবিষ্যতে এই শহরটি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলা পর্যন্ত প্রসারিত করা হতে পারে। শিল্পনগরটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম এবং প্রথম পরিকল্পিত অত্যাধুনিক শহর হবে। [মোহাম্মদ আবদুল মজিদ]