ফৌজদারি আইন

ফৌজদারি আইন  অপরাধ দমন ও অপরাধ উদ্ঘাটন, অপরাধীদের বিচার এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে অপরাধীদের প্রদত্ত শাস্তি বা দন্ডের পরিমাণ সম্পর্কিত আইনবিধান। ফৌজদারি আইন ইংরেজ ও দেশীয় প্রথার সমন্বয়ে দীর্ঘকাল ধরে বিকশিত হয়েছে। দেশীয় প্রথার ছিল দুটি ভিন্ন ধারা। একটি ধারা ছিল মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অর্থাৎ মুসলিম আইনের আওতাভুক্ত। অপরদিকে ছিল হিন্দু প্রথা ও রীতিনীতি। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ফৌজদারি আইন প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করতে প্রায় তিন দশক সময় লেগে যায়। আইনের এই সারগ্রন্থ রচনা ছিল দুটি আইন কমিশনের শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টার ফল। টমাস বেবিংটন ম্যাকলের নেতৃত্বে প্রথম কমিশন গঠিত হয় ১৮৩৭ সালে। দ্বিতীয় কমিশন ১৮৫৩ সালে ইংল্যান্ডে গঠন করা হয়।

এ সময়ের অন্যতম বিতর্কিত বিষয় ছিল ভারতে অবস্থানকারী ইউরোপীয় এবং ভারতীয়দের জন্য স্বতন্ত্র বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন। ইউরোপীয়দের পৃথক আদালত এবং স্বতন্ত্র আইনের অধীনে আনা হয়েছিল। একই আইনের অধীনে নিরাপত্তা বিধানের সমতা এবং আইনের শাসনের নীতির উপর ভিত্তিশীল অভিন্ন বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠে। এক্ষেত্রেই ম্যাকলে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আইন প্রণয়নের ভিত্তির নীতিমালা নির্ধারণ করে দেন। তিনি একটি সর্বজনীন সমতার নীতি নির্ধারণ করেন এবং যেক্ষেত্রে তা সম্ভব সেক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে পার্থক্য সৃষ্টি করা। এটিই ছিল পথনির্দেশক নীতি যার মাধ্যমে বিচার প্রশাসনের দ্বৈত ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের লক্ষ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এ প্রক্রিয়ার ফলেই প্রণীত হয় ভারতীয় পেনাল কোড (১৮৬০ সালের ৪৫ নম্বর আইন) এবং ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৬১ সালের ২৫ নম্বর আইন)। এ দুটি কোডই ব্রিটিশ ভারতে ফৌজদারি আইনের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৪৭ সালের পর ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান পেনাল কোড করা হয়। অনুরূপভাবে ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তান পেনাল কোড বাংলাদেশ পেনাল কোড নামে পরিচিত হয়। নামের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ছাড়া সামান্য কিছু পরিমার্জন সহ পেনাল কোড প্রায় অপরিবর্তনীয় থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধি সম্পর্কেও ওই একই কথা বলা যায়। এটি প্রণীত হয় পেনাল কোডে সংযোগ করার জন্য, কেননা পেনাল কোডই ছিল প্রকৃত বস্ত্তনিষ্ঠ ফৌজদারি আইন। আইন বিশেষজ্ঞগণ এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। ফৌজদারি কার্যবিধি একটি বিশেষণমূলক বা প্রক্রিয়াগত আইন, আর পেনাল কোড হলো স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত বাস্তব আইনবিধান। এ পার্থক্য শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তিসিদ্ধ। ফৌজদারি কার্যবিধিতে রয়েছে অপরাধ দমনের জন্য এবং অপরাধীকে পেনাল কোডে অথবা কোন বিশেষ বা স্থানীয় আইনে (ঐ আইনে কোন বিধান না থাকলে) বর্ণিত অপরাধ সংঘটনের কারণে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করার বিধিসমূহ। কার্যবিধিতে বিচারের জন্য আদালতের শ্রেণি এবং তাদের অধিক্ষেত্রও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এতে রয়েছে তদন্ত, বিচারকার্য বা অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন আদালত কর্তৃক অনুসরণযোগ্য কার্যপ্রণালী বিধি।

অবশ্য একথা বলা সংগত হবে যে, ম্যাজিস্ট্রেটদের সহায়তা ও তথ্য প্রদান করা, পুলিশ ও গ্রেফতারকারী ব্যক্তিবর্গ, দলিলপত্র দাখিল ও অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি উপস্থাপন করতে বাধ্য করার প্রক্রিয়া এবং অন্যায়ভাবে আটককৃত ব্যক্তিবর্গকে উদ্ঘাটন, পুলিশের নিবর্তনমূলক কাজ, স্ত্রীদের ও সন্তানদের ভরণপোষণ করা, হেবিয়াস কর্পাসের প্রকৃতিতে নির্দেশনা এবং সম্পত্তি বিক্রয় বা বিলি ব্যবস্থার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যেগুলো প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত আইন। অপরদিকে পেনাল কোডের বিষয় হচ্ছে কোনো অপরাধের প্রকৃতির সংজ্ঞা দান এবং আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হলে যথোপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করা। এটিই হচ্ছে প্রক্রিয়াগত আইন এবং স্বাধীন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত আইনের মধ্যে পার্থক্য।

পেনাল কোডের দন্ডবিধান ছাড়াও বিশেষ এবং স্থানীয় আইন ফৌজদারি আইনের আওতাভুক্ত। বিশেষ আইনসমূহ বিশেষ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেগুলো পেনাল কোডে অন্তর্ভুক্ত হলেও তা যথার্থ শাস্তি বা দ্রুত বিচারের নিশ্চয়তা দেয় না। দৃষ্টান্তের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত আইন, নির্যাতন বা আক্রমণ থেকে মহিলাদের রক্ষা করার জন্য আইন, ইত্যাদি। স্থানীয় আইনসমূহ প্রধানত পৌর আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তা নগর এলাকায় সংঘটিত অপরাধ দমন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত।  [এ.এম.এম শওকত আলী]