প্রহসন

প্রহসন  হাস্যরসপ্রধান স্বল্পদৈর্ঘ্য নাট্যধর্মী রচনা। এতে হাস্য ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের আবরণে সমাজের অনৈতিকতা, অনাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতা এবং প্রাত্যহিক জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ তুলে ধরা হয়। পূর্ণাঙ্গ নাটকের মতো প্রহসনে বিষয়বস্ত্তর বিস্তার ও জটিলতা, রচয়িতার গভীর জীবনবোধ, চরিত্রের সমগ্রতা এবং কাহিনীর পারম্পর্যপূর্ণ অগ্রগমন অনুপস্থিত। বরং নকশাধর্মী কাহিনীর মাধ্যমে ঘটনা ও বিষয়বস্ত্তর অতিকথন, টাইপ চরিত্রের সংযোগ এবং হাসি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহযোগে খন্ডজীবনের একটি উপভোগ্য নাট্যরূপায়ণই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। ফলে প্রহসনের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক থেকে দুই অঙ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এতে হাস্যরস প্রধান হলেও আধুনিক প্রহসনে করুণরসেরও প্রয়োগ দেখা যায়। প্রহসনে সাধারণত টাইপধর্মী চরিত্রের মাধ্যমে সমকালীন ঘটনাবলি চিত্রিত হয়। চরিত্রের শ্রেণী ও অবস্থান অনুযায়ী ভাষা ও তির্যক সংলাপ প্রহসনের প্রাণ।

১৭৯৫ সালে জোডরেলের The Disguise নাটক অবলম্বনে গোলকনাথ দাস কর্তৃক অনূদিত কাল্পনিক সংবদল নাটকে প্রহসনের কিছু বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তবে বাংলা প্রহসনের উদ্ভব মূলত  সংস্কৃত প্রহসনের প্রভাবে। কৌতুকরত্নাকর (কবিতার্কিক, ১৭শ শতক), হাস্যার্ণব (জগদীশ, ১৮২২), কৌতুকসর্বস্ব (রামচন্দ্র তর্কালঙ্কার, ১৮২৮) প্রভৃতি সংস্কৃত প্রহসন বাংলা প্রহসনের ভিত্তি নির্মাণ করে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই বাংলা প্রহসনের বিকাশ সাধিত হয়। বাঙালি হিন্দু সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতা, ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ ও ইন্দ্রিয়সাধনা ইত্যাদি বাংলা প্রহসনের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে গৃহীত হয়। আধুনিকতা তথা ইংরেজি শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত ডিরোজিওর শিষ্য ইয়ংবেঙ্গলদের ধর্মহীনতা, মদ্যপান, জীবন উপভোগের অনৈতিক ও প্রবল বাসনা এবং এতদ্সংক্রান্ত অমিতাচার এতে নতুন মাত্রা যোগ করে। তখন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি প্রহসনকারেরা ইংরেজি Farce-এর অনুকরণে প্রহসন রচনায় আধুনিকতার ছোঁয়া আনলেও সংস্কৃত প্রহসনের বৈশিষ্ট্যই তাদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মধ্যযুগের  বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যের হাস্যরস-সমৃদ্ধ বিষয় ও অনুষঙ্গগুলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬) সংস্কৃত প্রহসনের আদর্শে বাংলা প্রহসন রচনার পথিকৃৎ। তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রহসন হচ্ছে কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪)। সমকালীন সামাজিক সমস্যা অবলম্বনে রচিত এ নাটকে তিনি হিন্দু সমাজের কৌলীন্য প্রথার কদর্য রূপ তথা কুলীন ব্রাহ্মণদের বিবাহবহির্ভূত যৌনবাসনা চরিতার্থের উদগ্র কামনা এবং তৎকারণে পিষ্ট ও দলিত কুলীন তনয়াদের বেদনাময় পরিণতিকে তুলে ধরেছেন। কুলীনকুলসর্বস্ব একটি সার্থক প্রহসন। এতে কাহিনীর ধারাবাহিক অনুসরণের চেয়ে নকশাধর্মিতার প্রতিই নাট্যকারের প্রবণতা লক্ষণীয়। এর প্রধান রস হাস্য। তাছাড়া এর সংলাপে যেমন চরিত্রের শ্রেণী ও অবস্থানকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে, তেমনি চরিত্রগুলিও হয়ে উঠেছে টাইপধর্মী, যারা প্রত্যেকেই বিশেষ বিশেষ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছে। রামনারায়ণ রচিত অন্যান্য অপ্রধান প্রহসন হচ্ছে যেমন কর্ম তেমনি ফল (১৮৬৫), চক্ষুদান (১৮৬৯), উভয় সঙ্কট (১৮৭২) ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যে প্রথম পাশ্চাত্যধারা তথা ইংরেজি Farce-এর বৈশিষ্ট্য ও গুণ সমন্বিত প্রহসন রচনায় কৃতিত্বের অধিকারী হলেন  মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। মূলত তাঁর একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০) ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) প্রহসনদ্বয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা প্রহসন তার স্বকীয়তা লাভ করে। প্রথমটিতে মধুসূদন উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত ইয়ংবেঙ্গলদের অতি আধুনিকতা, জীবন উপভোগের প্রবল বাসনা, অমিতাচার ও উগ্রতাকে তীব্র পরিহাসের রূপকে তুলে ধরেছেন। আর দ্বিতীয়টিতে তিনি সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে রূপায়িত করেছেন কুলীন ব্রাহ্মণদের নারী উপভোগের বিকৃত বাসনাকে। এ প্রহসন দুটিতেই মধুসূদন তাঁর পাশ্চাত্য সাহিত্য ও জীবনচেতনা অধ্যয়নের প্রথম প্রকাশরূপে ইংরেজি Comedy of manners-এর রস ও রীতিকে গ্রহণের মাধ্যমে বাংলা প্রহসনকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দান করেছেন। তাছাড়া প্রহসন দুটির কাহিনী যেমন তৎকালীন সমাজের অমিতাচার ও অনাচারকে হাস্য-বিদ্রূপের রূপকে ধারণ করে প্রহসনের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে, তেমনি কাহিনীর সংক্ষিপ্ত আয়তন, নকশাধর্মী বিন্যাস, সরস ও চরিত্রানুগ সংলাপ এবং চরিত্রের সামাজিক বাস্তবতা প্রতিপন্নের জন্য আঞ্চলিক তথা গ্রামীণ ভাষা প্রযুক্ত করে বাংলা প্রহসনকে সমৃদ্ধির শীর্ষভাগে উন্নীত করেছেন।

মধুসূদনের পাশাপাশি  দীনবন্ধু মিত্র (১৮১৯-৭৩) বাংলা প্রহসনকে আরও সমৃদ্ধি ও সার্থকতা দান করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রহসনগুলি হচ্ছে: বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬), সধবার একাদশী (১৮৬৬) জামাইবারিক (১৮৭২) ইত্যাদি। বিয়ে পাগলা বুড়োতে তিনি এক বৃদ্ধের পৌনঃপুনিক বিবাহের উদগ্র আকাঙ্ক্ষাজনিত চারিত্রিক অসঙ্গতি নিপুণ ব্যঙ্গের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। পাশাপাশি বিষয়ভাবনার গভীরে প্রবেশ না করে রসালো সংলাপের সঙ্গে গ্রাম্য  ছড়া ও কবিতা পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি বাংলা প্রহসনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। সধবার একাদশীতে কমেডি ও ট্র্যাজেডির যুগল সন্নিবেশ ঘটলেও প্রহসনের বৈশিষ্ট্য অধিকমাত্রায় প্রতিমূর্ত। মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতার মতো এ নাটকেও হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে দীনবন্ধু মিত্র উনিশ শতকের উদগ্র জীবনবাসনার প্রতীক ইয়ংবেঙ্গলদের প্রতিনিধি নিমচাঁদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা ও বিষাদবহুল পরিণতি চিত্রায়িত করেছেন এবং তৎকালীন সমাজজীবনের অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন। স্ত্রীপ্রধান প্রহসন জামাইবারিকে দীনবন্ধু তৎকালীন হিন্দু সমাজের ঘরজামাইয়ের সমস্যা, বহুবিবাহের বিড়ম্বনা ও পারিবারিক বিষাদ উপস্থাপনসহ হাসি-আনন্দ ও অফুরন্ত কৌতুকরসের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। তবে আঙ্গিকের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে সধবার একাদশী ও জামাইবারিকের প্রহসনবৈশিষ্ট্য কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

বাংলা প্রহসন সাহিত্যে  অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯) আর একজন কীর্তিমান লেখক। প্রথম প্রহসন চোরের উপর বাটপাড়ি-তে (১৮৭৬) তিনি ততটা সফল না হলেও ডিস্মিস্ (১৮৮৩), চাটুজ্যে-বাড়ুজ্যে (১৮৮৪), বিবাহ বিভ্রাট (১৮৮৪), বাবু (১৮৯৩) ইত্যাদির মাধ্যমে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা  গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২) রচিত প্রহসনের সংখ্যাধিক্য যেমন লক্ষণীয়, তেমনি সেগুলির গুণগত উৎকর্ষও অভিব্যঞ্জিত। তাঁর রচিত প্রহসনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: যামিনী চন্দ্রমাহীনা, গোপন চুম্বন (১৮৭৮), ভোটমঙ্গল (১৮৮২), বেল্লিক বাজার (১৮৮৬) ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রহসন রচনায়ও পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। গোড়ায় গলদ (১৮৯২) প্রহসনের প্রতিটি দৃশ্যে তিনি যেমন হাস্যরসের প্রবাহ ছুটিয়েছেন, তেমনি বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭) নামক প্রহসনেও বৈকুণ্ঠের বেদনাময় পরিণতি রূপায়ণে সূক্ষ্ম হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। এতদ্ব্যতীত রচনাকৌশলের গুণগত উৎকর্ষে যে-সকল প্রহসন উল্লেখযোগ্য সেগুলি হলো: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিঞ্চিৎ জলযোগ (১৮৭২), মনোমোহন বসুর নাগাশ্রমের অভিনয় (১৮৭৪), রাজকৃষ্ণ রায়ের ডাক্তার বাবু (১৮৯০), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিরহ (১৮৯৭), ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ভূতের বেগার (১৯০৮), প্রমথনাথ বিশীর ভূতপূর্ব স্বামী ইত্যাদি।

বিশ শতকের প্রথমভাগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে প্রহসন রচনার তাগিদ ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই পরবর্তীকালে আর প্রহসন তেমন রচিত হয় নি; যা-ও হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য নয়।  [হাকিম আরিফ]

গ্রন্থপঞ্জি  আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড), এ মুখার্জী এন্ড কোং প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৭৫; প্রদ্যোত সেনগুপ্ত, বাংলার সামাজিক জীবন ও নাট্যসাহিত্য, সাহিত্যশ্রী, কলকাতা, ১৯৭৬; গোলাম মুরশিদ, সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৪; অশোককুমার মিশ্র, বাংলা প্রহসনের ইতিহাস, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৮৮।