প্রবাল

প্রবাল (Coral)  সেলেনটারাটা পর্বভুক্ত সমুদ্র তলদেশবাসী অবৃন্তক, অমেরুদন্ডী কীট (Anthozoa)। অ্যানথোযোয়া কীটসমূহ সাধারণত বহিঃত্বকের চারপাশে একধরনের অস্থিময় বস্ত্ত ক্ষরণ করে এবং তাতে প্রস্তরবৎ বা চুনময় একটি অতিরিক্ত কঙ্কাল সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রকৃত বহিঃকঙ্কাল কাঠামোটি কীটটির নিম্নাংশের বহিঃপৃষ্ঠের আকার ধারণ করে। এভাবে প্রতিটি কীটের চারপাশে ও নিচে এক ধরনের কাপ বা থালা আকৃতির কাঠামো তৈরি হয়। গঠিত বস্ত্তটিই থিকা (theca) বা প্রবালাংশ (corallite) নামে পরিচিত। দলবদ্ধ অ্যানথোযোয়া প্রতিটি কীটের মধ্যে অতিরিক্ত অস্থিময় বস্ত্ত ক্ষরণের মাধ্যমে সংলগ্ন প্রবালাংশগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির কাঠামোয় একসঙ্গে গ্রথিত করে। একটি সম্পূর্ণ কঙ্কাল, তা এটি একটি অ্যানথোযোয়ার একক থিকা হোক অথবা দলবদ্ধ অ্যানথোযোয়ার যুক্ত থিকা হোক, প্রবাল নামে অভিহিত। একটি প্রবালাংশের আকৃতি, প্রাচীরের গঠন ও অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য জীবাশ্ম-প্রবাল গবেষণাকারী প্রত্নজীবাশ্ম বিশারদদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্ব্রীয় (আজ থেকে ৫৭০ থেকে ৫০৫ মিলিয়ন বছর আগে) যুগের পরবর্তী সকল যুগের জীবাশ্ম রেকর্ডে প্রবালের আধিক্য বিদ্যমান। কোনও এক অতীতে প্রবালের এত আধিক্য ছিল যে প্রাচীন সমুদ্রসমূহকে, বর্তমান সমুদ্রের বিশেষ বিশেষ অংশের মতো প্রবাল সাগর হিসেবে অভিহিত করা হতো। প্রাচীনকালের এই সব প্রবাল তীর ও প্রাচীর তৈরি করেছিল যা আজ স্তরীভূত চুনাপাথর ও কর্দম শিলার মধ্যে বিশাল অবয়বহীন বস্ত্তর আকারে পড়ে আছে। সম্প্রতি এই সব প্রাচীন প্রাচীর, যা বায়োহার্ম (bioherms) নামেও পরিচিত, পেট্রোলিয়ামের সম্ভাব্য আধার হিসেবে বেশ কৌতুহল জাগিয়ে তুলেছে।

বিভিন্ন ধরনের প্রবাল,সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ

প্রায় ২২º সেলসিয়াস তাপমাত্রাবিশিষ্ট পানি প্রবালের বিকাশ লাভের জন্য সর্বোত্তম। অন্যদিকে ১৮ºসে-এর কম তাপমাত্রা প্রবাল সহ্য করতে পারে না। যে কারণে অধিকাংশ আধুনিক প্রবাল প্রাচীর ২৮º উত্তর ও দক্ষিণ দ্রাঘিমার মধ্যবর্তী ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলভাগের মহীতট ও দ্বীপ তটভূমিতে সীমাবদ্ধ। জানা মতে বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর, দি গ্রেট বেরিয়ার রিফ অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ডে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ১৯৩০ কিমি এবং প্রস্থ ১৬ থেকে ১৪৫ কিমি। বাংলাদেশে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপেই একমাত্র প্রবাল গঠিত হয়েছিল। এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন প্রবালের বয়স ৩৩,২৩৮ বছর (C14 dating)। প্রবাল জন্ম নেওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ এখনও বিরাজমান। তবে দ্বীপটির ভূ-গাঠনিক ক্রিয়া (Neotectonic activity) এদের বড় ধরনের ক্ষতি করছে।

সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের প্রবালগুলো বালুকাবেলায় এবং দ্বীপ অভ্যন্তরের স্থলভাগে শিলারাশির মধ্যে প্রধানত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বালময় তটভূমিতেও কিছু বিচ্ছিন্ন খন্ড দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ প্রবালখন্ডই আকারে ছোট। তবে কিছু এলাকায় বড় আকৃতির প্রবালও চোখে পড়ে। এই দ্বীপে ২১ প্রজাতির জীবাশ্ম প্রবাল চিহ্নিত করা গেছে। সেগুলো হচ্ছে: Porites labota, P. lutea, P. solida, Platygyrn sp, Goniopora stokesi, G. columna, Favia favus, Favites chinesis, F. helicora, Goniastrea retiformes, G. aspera, G. pendulus, Cyphastrea. seralila, C. yphastrea sp., Favites sp., Galaxea astrea, Acropora aculeus, A. glaucarudis and Montipora informis. অবশ্য এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই প্রকৃত প্রাচীর গঠনকারী প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে না।

একইভাবে জীবন্ত প্রবালের ৩৯টি প্রজাতিও চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে Porifies, Favites, Goniopora, Cyphastrea ও Goniastrea প্রজাতির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৭টি পরিবার প্রবালের প্রতিনিধিত্ব করে। কয়েকটি নরম প্রবাল এবং যোয়ানথিডও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এইসব জীবন্ত প্রবাল, দ্বীপটিতে বর্তমান নব ভূ-গাঠনিক ক্রিয়াকলাপের কারণে শীঘ্রই মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বীপটি বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১৯ মিমি হারে উত্থিত হচ্ছে।

মধ্য অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়কালে যখন সমুদ্র শান্ত, এবং জোয়ারভাটার মাত্রা অনুকূল থাকে তখন স্থানীয় লোকজন প্রবাল সংগ্রহ করে। সাধারণত পূর্ণিমা ও নতুন উদিত চাঁদের সময় প্রবাল সংগ্রহ করা হয়। প্রধানত চার ধরনের প্রবাল সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এদের নাম হচ্ছে পাতাফুল (Acropora sp), গাছফুল (Acropra sp), শৈবাল (Favia sp) ও মগ (Goniastrea sp)। এদের মধ্যে Acropora-র চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাহারি অলংকরণের উদ্দেশ্যেই প্রবালের ব্যবহার সর্বোচ্চ।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

আরও দেখুন সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ