পেশা ও কারিগরি শিক্ষা

পেশা ও কারিগরি শিক্ষা  পেশাগত শিক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের দক্ষ কর্মশক্তিকে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কর্মসূচির মাধ্যমে উন্নত করে অধিকতর উৎপাদনশীল করা হয়।

পেশাগত শিক্ষার পাঠক্রম সাধারণ শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা সংক্রান্ত শিক্ষার সমন্বয়ে গঠিত। এক্ষেত্রে, সাধারণ শিক্ষার অংশটুকু প্রায়োগিক বিষয়সমূহের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়। জাতীয় দক্ষতা মান (ন্যাশনাল স্কিল স্ট্যান্ডার্ড বা এনএনএস) দ্বারা পেশার বিষয়বস্ত্ত নির্ধারিত। জাতীয় দক্ষতা মানের শ্রেণিগুলি হচ্ছে বুনিয়াদি, এনএনএস-২ এবং স্নাতকোত্তর। সুনির্দিষ্ট পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রমের নামগুলি হচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সার্টিফিকেট (পেশাগত) বা এস.এস.সি (পেশা); উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (পেশাগত) বা এইচ.এস.সি (পেশা) এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা) বা এইচ.এস.সি (বি.এম)।

দুবছর মেয়াদি এস.এস.সি (পেশা) শিক্ষাসূচি বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণিতে অনুসরণ করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১,৫১২ শিক্ষাঘণ্টা ক্লাস করতে হয় এবং সেসঙ্গে সরেজমিন কাজে বছরে আট সপ্তাহ শিক্ষানবিশি করতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা এস.এস.সি (পেশা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কারিগরি ও পেশাগত কিংবা সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, অথবা এনএনএস গ্রেড-২ কারিগর হিসেবে চাকরিতে নিয়োগ পেতে পারে।

এস.এস.সি (পেশা)-তে অন্তর্ভুক্তির জন্য সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে আট বছর সফল অধ্যয়ন প্রয়োজন। ৫০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬৪টি পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং ১২টি প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এস.এস.সি (পেশা) শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। কৃষি,  মৃৎশিল্প, প্রকৌশল, মৎস্যচাষ, চামড়া শিল্প, পশুপালন, সুতি বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি বিষয়ে এস.এস.সি (পেশা) শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রথম বর্ষে বিভিন্ন পেশার প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫৩,৪৮০।

বিদ্যালয়ের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুইবছর মেয়াদি এইচ.এস.সি (পেশা) পাঠক্রম সম্পন্ন হয়। এইচ.এস.সি (পেশা) পাঠক্রমের ছাত্রছাত্রীদের মোট ১,৫১২ শিক্ষাঘণ্টা ক্লাস করতে হয় এবং দুইবছরে আট সপ্তাহ সরেজমিন শিক্ষানবিশি করতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা এইচ.এস.সি (পেশা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কারিগরি, প্রকৌশল এবং শিক্ষার সাধারণ ধারায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, অথবা এনএনএস গ্রেড-১ অর্থাৎ অতিদক্ষ কারিগর হিসেবে চাকরিতে নিয়োগ পেতে পারে। এইচ.এস.সি (পেশা) পাঠক্রমের প্রথম বর্ষে ছাত্রছাত্রীদের আসন সংখ্যা ২,৮০০। ৬৪টি পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে এইচ.এস.সি (পেশা) পাঠক্রম চালু আছে।

এইচ.এস.সি (বি.এম) পাঠক্রমে ছাত্রছাত্রীদের ১,৪৪০ শিক্ষাঘণ্টা ক্লাস করতে হয় এবং বছরে আট সপ্তাহ সরেজমিন শিক্ষানবিশি করতে হয়। এইচ.এস.সি (বি.এম) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ছাত্রছাত্রীর সাধারণ ধারায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং নিম্নপর্যায়ের দাপ্তরিক কাজে চাকরি নিতে পারে। পাঁচটি বিশেষ ক্ষেত্রে এই শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। এগুলি হচ্ছে কম্পিউটারে কার্যচালনা, সাচিবিক বিদ্যা, হিসাব, ব্যাংকিং এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ। এইচ.এস.সি (বি.এম) শিক্ষাশ্রেণিতে ভর্তির জন্য যেকোন শাখায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় সার্টিফিকেট প্রয়োজন। ২৪৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইচ.এস.সি (বি.এম) শিক্ষাক্রম চালু আছে। প্রথম বর্ষে ছাত্রছাত্রীর আসনসংখ্যা হচ্ছে ৯,৭২০। পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী অনুপাত হচ্ছে ১:১২।

কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো বিশেষ ধরনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের উপযোগী দক্ষতাসম্পন্ন মধ্যমানের আবেক্ষণিক কারিগরি কর্মিবাহিনী সৃষ্টি করা। দেশে কারিগরি শিক্ষায় তিনবছর মেয়াদি ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রম চালু আছে। এই শিক্ষাক্রমে ভর্তির যোগ্যতা হচ্ছে যেকোন শাখায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় সার্টিফিকেট। এই শিক্ষাক্রম চালু আছে ২০টি বহুমুখী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এবং আরও ২০টি নতুন বহুমুখী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপিত হতে যাচ্ছে, ১৭টি কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ৬টি বস্ত্রবয়ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ১টি বনশিল্প বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে, ১টি মুদ্রণশিক্ষা বিষয়ক বিদ্যালয়ে এবং ১টি কাচশিল্প ও মৃৎশিল্প বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন সংখ্যা ১৩,০০০-এরও অধিক। শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী অনুপাত প্রায় ১:১০। দেশের সবগুলি কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রম বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় পরিচালিত হয়।

পেশাগত শিক্ষার শিক্ষকদের জন্য প্রধানত দুই ধরনের শিক্ষক-শিক্ষণ পাঠক্রম চালু আছে। একটি হলো পেশাগত শিক্ষার শিক্ষকদের শিক্ষা সার্টিফিকেট এবং অন্যটি হলো পেশাগত ডিপ্লোমা পর্যায়ের শিক্ষার শিক্ষকদের পাঠক্রম। এসব পাঠক্রম পরিচালনা করছে বগুড়ায় অবস্থিত পেশাগত শিক্ষার শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। পেশাগত শিক্ষার শিক্ষকদের শিক্ষা সার্টিফিকেট পাঠক্রমে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হচ্ছে এস.এস.সি (পেশা) অথবা প্রকৌশল ডিপ্লোমা। ডিপ্লোমা পর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষকদের এসব শিক্ষণ পাঠক্রমে ভর্তি হতে হলে প্রয়োজন পেশাগত শিক্ষার শিক্ষকদের শিক্ষা সার্টিফিকেট। এসব শিক্ষক-শিক্ষণ পাঠক্রমও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় পরিচালিত হয়। পেশাগত শিক্ষার শিক্ষক-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা ১২০।

কারিগরি শিক্ষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ঢাকাস্থ কারিগরি শিক্ষার শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে দেওয়া হয়। এই মহাবিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা মানের একবছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষাক্রম এবং কারিগরি শিক্ষায় দুবছর মেয়াদি বিজ্ঞান স্নাতক (বি.এসসি) শিক্ষাক্রমের ব্যবস্থা আছে। কারিগরি শিক্ষার ডিপ্লোমা শিক্ষাক্রম বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং বিজ্ঞান স্নাতক শিক্ষাক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত। কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা ১২০।

সুতিবস্ত্র ও চামড়ার ক্ষেত্রে পেশাগত প্রযুক্তিবিদ তৈরি করার জন্য প্রযুক্তিবিদ্যায় শিক্ষার পাঠক্রম আছে। সুতিবস্ত্র প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সূতা উৎপাদন, বস্ত্রবয়ন, ওয়েট প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পোশাক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। চর্ম প্রযুক্তির যেসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তৈরির ব্যবস্থা আছে সেগুলি হচ্ছে চামড়া, জুতা এবং চর্মজাত দ্রব্যাদির প্রযুক্তি। এ জাতীয় সব প্রশিক্ষণ পাঠক্রমই চার বছর মেয়াদি। এগুলিতে ভর্তির যোগ্যতা হলো উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট অথবা বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শাখায় সফলভাবে ১২ বছর অধ্যয়ন। ঢাকাস্থ বস্ত্র প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ে বস্ত্র প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাক্রম এবং চর্ম প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ে চর্ম প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাক্রম পরিচালিত হয়। বস্ত্র প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় ও চর্ম প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে আসন সংখ্যা যথাক্রমে ১৬০ ও ১২০।  [আব্দুর রফিক]