পিরোজপুর জেলা

পিরোজপুর জেলা (বরিশাল বিভাগ)  আয়তন: ১২৭৭.৮০ বর্গ কিমি। অবস্থান: ২২°০৯´ থেকে ২২°৫২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৫২´ থেকে ৯০°১৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। সীমানা: উত্তরে গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা, পূর্বে ঝালকাঠি জেলা, পশ্চিমে বাগেরহাট জেলা।

জনসংখ্যা ১১১৩২৫৭; পুরুষ ৫৪৮২২৮, মহিলা ৫৬৫০২৯। মুসলিম ৯২৫৮৯৫, হিন্দু ১৮৬৮৬৫, বৌদ্ধ ২১০, খ্রিস্টান ২১৬ এবং অন্যান্য ৭১।

জলাশয় প্রধান নদী: বলেশ্বরী, কচা, স্বরূপকাঠি ও কালীগঙ্গা; চাতার বিল ও জুজখোলা খাল উল্লেখযোগ্য।

প্রশাসন জেলা গঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৮৬ সালে। জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে মঠবাড়ীয়া উপজেলা সর্ববৃহৎ (৩৪৪.২৩ বর্গ কিমি) এবং সবচেয়ে ছোট উপজেলা কাউখালী (৭৯.৫৬ বর্গ কিমি)।

জেলা
আয়তন (বর্গ কিমি) উপজেলা পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
শহর গ্রাম
১২৭৭.৮০ ৫১ ৩৯১ ৬৪৮ ১৮২৬৩১ ৯৩০৬২৬ ৮৭১ ৬৪.৯
জেলার অন্যান্য তথ্য
উপজেলার নাম আয়তন(বর্গ কিমি) পৌরসভা ইউনিয়ন মৌজা গ্রাম জনসংখ্যা ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি) শিক্ষার হার (%)
কাউখালী ৭৯.৫৬ - ৪৫ ৫৯ ৭০১৩০ ৮৮১ ৬৪.৬
জিয়ানগর ৯১.৭৮ - ২৯ ৪৮ ৭৭২১৭ ৮১৬ ৬১.২
নাজিরপুর ২২৮.৬৯ - ৬৯ ১৭১ ১৮০৪০৮ ৭৮৯ ৫৯.৩
নেছারাবাদ ২০০.৩৩ ১০ ৮০ ১৩৪ ২১১০৩২ ১০৫৩ ৬৮.৬
পিরোজপুর সদর ১৬৬.৮১ ৬৪ ৯৮ ১৬৩৪৭০ ৯৮০ ৭৩.৩
ভান্ডারিয়া ১৬৩.৫৬ - ৩৭ ৪৫ ১৪৮১৫৯ ৯০৬ ৬৭.৭
মঠবাড়ীয়া ৩৪৪.২৩ ১১ ৬৭ ৯৩ ২৬২৮৪১ ৭৬৪ ৬১.৭

সূত্র আদমশুমারি রিপোর্ট ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

ঐতিহাসিক ঘটনা এ জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার সিংখালিতে ১৭৫৭ সালে কৃষক বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন যুগপৎ চালাবার প্রস্তাব পাশ হলে পিরোজপুরেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চাখারের উকিল মফিজউদ্দিন ও সৈয়দ হাবিবুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালে ‘কুলকাঠি হত্যাকাণ্ড’-র প্রতিবাদে পিরোজপুরে আন্দোলন সংগঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে আগস্ট মাসে সুবাদার আজিজ সিকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভান্ডারিয়া উপজেলার ভান্ডারিয়া থানা আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর জেলার কালীগঞ্জের পাকসেনা ও রাজাকারদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যাতে ১০-১৫ জন পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। এছাড়া বাঘমারাতেও একটি যুদ্ধ হয়। ২৯ নভেম্বর ভান্ডারিয়া বন্দর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে এই উপজেলা থেকে পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। কাউখালী উপজেলার কেউন্দিয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাটি ছিল। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধারা কাউখালী থানা আক্রমণ করে অস্ত দখল করে নেয়। সেপ্টেম্বর মাসে কেউন্দিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের লড়াইয়ে ১৭ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এছাড়া আমড়াঝুড়িতে পাকসেনারা ৩০ জন লোককে হত্যা করে এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পিরোজপুর সদর উপজেলায় পাকসেনাদের সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে তথ্য সরবরাহের অপরাধে ভাগীরথী (বীরাঙ্গনা)-কে পাকসেনারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় মোটর সাইকেলের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে মৃত্যু ঘটিয়ে তার লাশ বলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয়। মঠবাড়ীয়া উপজেলায় মে মাসে ঝাটিপুনিয়া নামক স্থানে রাজাককারবাহিনী ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। নাজিরপুর উপজেলায় ১৫ মে পাকসেনারা দীর্ঘা ইউনিয়নে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। ৩ ডিসেম্বর রাজাকার ও পাকসেনারা সাতকাছেমিয়া ও বাইনকাঠি গ্রামে ৭ জন লোককে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১১ মে নেছারাবাদ উপজেলায় পাকসেনারা সর্বপ্রথম আক্রমণ করে। মে-জুন মাসে পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় মিয়ারহাট ও ইন্দেরহাট বন্দরসহ বিভিন্ন গ্রামের বাড়িঘর ও দোকানে ব্যাপক লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা প্রায় ১০০ লোককে হত্যা করে। সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাকান্ড চালায় আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কুড়িয়ানা কলেজের পিছনের একটি ডোবা থেকে প্রায় তিনশত মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। জেলায় ২টি স্থানে বধ্যভূমি ও ১টি স্থানে গণকররের সন্ধান পাওয়া গেছে; স্বর্গবানীতে ১টি ভাস্কর্য ও বলেশ্বর খেয়াঘাটে ১টি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে।

শিক্ষার হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার ৬৪.৯%; পুরুষ ৬৫.০%, মহিলা ৬৪.৭%। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: পিরোজপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ, ভান্ডারিয়া সরকারি কলেজ, কাউখালী ডিগ্রি কলেজ, মঠবাড়িয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ, স্বরূপকাঠি মহাবিদ্যালয় (১৯৬৫), পিরোজপুর সরকারি বালক বিদ্যালয় (১৯০৯), পিরোজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৯৩), পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৯), পাড়েরহাট রাজলক্ষ্মী মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯১৫), কদমতলা জর্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯১২), পিরোজপুর টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯১৭), ভান্ডারিয়া বিহারী লাল উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৩), বড় কানুয়া আবদুল মজিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯২৭), সুটিয়াকাঠি ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯০৯), খানাকুনিয়ারী পি.ই ফাজিল মাদ্রাসা (১৯২০)।

জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৫০.৮২%, অকৃষি শ্রমিক ৫.৭৫%, শিল্প ০.৭৮%, ব্যবসা ১৮.৭১%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ২.১৬%, চাকরি ৭.৬৯%, নির্মাণ ১.৩৬%, ধর্মীয় সেবা ১.৬১%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.৯৫% এবং অন্যান্য ১০.১৭%।

পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিক জনগণ (১৯৯২), সাপ্তাহিক: ভান্ডারিয়া বার্তা, পিরোজপুর মুক্তবার্তা (১৯৯৮), পিরোজপুর দর্পণ (১৯৮৫), বলেশ্বরী (১৯৯৮), পিরোজপুর বাণী (১৯৯৩), পাক্ষিক: মঠবাড়ীয়া সমাচার (১৯৯৭)। অবুলপ্ত: উপকূুল সমাচার, পিরোজপুর হিতৈষী, পরিচিতি, মুকুল, ধূুমকেতু, জনমত, দক্ষিণ দেশ, বাংলাদেশ, লালবার্তা, অন্যতম, প্রদীপ, ধলেশ্বর।

লোকসংস্কৃতি জেলার লোক-কাহিনীর মধ্যে গুণাইবিবি, আসমান সিংহের পালা অন্যতম। এছাড়া আমিনা বিবি ও  নছর মালুম, পালার গান, অধর মণি বৈষ্ণবীর গান, অনাথ বন্ধুর গান, আব্দুল গনি বয়াতির গান, কালু মোল্লার গান, খোয়াজ খিজিরের গান, গাজীর গান, কৃষ্ণলীলা প্রচলিত রয়েছে। লোকসংগীতের মধ্যে ভাটিয়ালী, সারিগান, মারফতি গান, মুকুন্দ দাশের গান, পল্লী গীতি, আব্দুল লতীফের গান উল্লেখযোগ্য।

দর্শনীয় স্থান পিরোজপুর জামে মসজিদ, মঠবাড়ীয়া সাপলেজা কুঠিবাড়ি, রায়েরকাঠী জমিদারবাড়ি এবং পাড়েরহাট জমিদারবাড়ি (পিরোজপুর সদর উপজেলা)।   [রঞ্জন বকসী নুপু]

আরও দেখুন সংশ্লিষ্ট উপজেলা।

তথ্যসূত্র  আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১ ও ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; পিরোজপুর জেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭; পিরোজপুর জেলার উপজেলাসমূহের  সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।