পাবনা কৃষক বিদ্রোহ

পাবনা কৃষক বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে ১৮৭৩ সালে জেগে ওঠা একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ। ইউসুফশাহী পরগনায় এ বিদ্রোহের সূচনা হয়। পরগনাটি বৃহত্তর পাবনা জেলাধীন বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। জমিদারগণ অবৈধ পন্থায় কৃষকদের কাছ থেকে বলপূর্বক আবওয়াব ও বর্ধিত হারে খাজনা আদায়ের চেষ্টা করত। খাজনা পরিশোধ না করার অজুহাতে প্রায়ই তারা কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করত। কৃষকগণ জমিদারদের এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে।

সিরাজগঞ্জের ইউসুফশাহী পরাগনায় নাটোর জমিদারির অংশ ক্রয়কারী নব্য জমিদারগণ বর্ধিত হারে কর আদায় এবং বিভিন্ন নামে আরোপিত অবৈধ কর আদায়ের জন্য নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকেন। ১৮৫৯ সালের Act X-এর আওতায় তিনটি সুনির্দিষ্ট কারণে জমিদারগণ জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারতেন। এগুলি ছিল; ক) যদি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একই ধরনের জমির খাজনার তুলনায় রায়ত কম খাজনা প্রদান করে, খ) যদি উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং গ) যদি রায়ত তার জমির যথার্থ পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণ জমির খাজনা প্রদান করে। জমিদারগণ এতটাই শক্তিধর ছিল যে, তারা এ সকল বিধি পাশ কাটিয়েও জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারতো।

উরকান্দি গ্রামের ৪৩ জন নেতৃস্থানীয় রায়তের বিরুদ্ধে দমনমূলক মোকদ্দমা দায়েরের ঘটনাই ছিল পাবনা কৃষক বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ। রায়তগণ বর্ধিত হারে দাবিকৃত খাজনা অবৈধ বলে তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। তারা আদালতে তাদের খাজনা জমা দেয়। জমিদারগণ তাদের দাবির স্বপক্ষে কাগজপত্র দাখিল করে অভিযোগ করে যে, রায়তরা বিগত এক দশক ধরে এ বর্ধিত খাজনা প্রদান করে আসছে। শাহজাদপুর কোর্টের মুন্সেফ ১৮৭২ সালের এপ্রিলে জমিদারদের পক্ষে রায় প্রদান করেন। ঐ বছর ডিসেম্বরে রাজশাহীর সিভিল জজ জমিদারদের পেশকৃত কাগজপত্র জাল ও বানোয়াট বিবেচনা করে উল্লিখিত রায় নাকচ করেন। আপীল কোর্টের রায়কে রায়তগণ জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের নৈতিক বিজয় বলে মনে করে।

অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের উদ্ভব পাবনা বিদ্রোহে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাট অর্থনীতি একটি নতুন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত রায়ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটায়। তারা জমিদারদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৭৩ সালে পাটের মূল্যে বড় ধস নামার পূর্ব পর্যন্ত পাট থেকে কৃষকরা ভাল আয় করছিল। জমিদারগণ কৃষকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে তাদের উপর আরোপিত খাজনা কমাতে রাজি হয় নি। পাট বাজারে ধসের ফলে কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তারা আসন্ন দুর্ভিক্ষাবস্থার মুখোমুখি হয়। এ পরিস্থিতিতে সিরাজগঞ্জের কয়েকজন জমিদার খাজনার হার বৃদ্ধি করে এবং তাতেই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়।

১৮৭৩ সালের মে মাসে ‘দি পাবনা রায়ত লীগ‘ গঠিত হয় এবং দিনে দিনে তার কার্যক্রম জেলার বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন ঈশানচন্দ্র রায়। সাধারণত তিনি ‘ঈশান রাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন কুদি মোল্লা ও শম্ভুনাথ পাল। তাঁরা তাদের পরগণাকে জমিদার নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেন এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মোকাবেলার জন্য একটি বিদ্রোহী বাহিনী গঠন করেন। বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বে বিশ্বস্ত নায়েব নিয়োগ করা হয়। কিছুসংখ্যক লোককে বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হয় এবং জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের মোতায়েন করা হয়। গঠন পর্যায়ে পাবনা আন্দোলন আইন মান্য করে অহিংস পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ক্রমে লীগের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা সহিংস বিদ্রোহে রূপ নেয়। লীগের কার্যক্রমে সাধারণের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার উপক্রম হলে সরকার জেলায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল ১৮৭৩ সালের ৪ জুলাই এক ঘোষণা জারি করেন। এতে সব ধরনের নিবর্তনমূলক কার্যক্রম থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য সরকারি প্রত্যয়ের কথা বলা হয় এবং জমিদারদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে, তারা যেন আইনসম্মতভাবে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেন। পুলিশি কার্যক্রম এবং ১৮৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ফলে এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।   [নূরুল হোসেন চৌধুরী]