ধ্রুপদ

ধ্রুপদ রাগসঙ্গীত বা শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের এক প্রধান শৈলী। ‘ধ্রুপদ’ শব্দ ‘ধ্রুবপদ’ শব্দের  অপভ্রংশ। ‘ধ্রুব’ অর্থ স্থির, নির্দিষ্ট ও সত্য  এবং ‘পদ’ অর্থ কথাযুক্ত গীত। তাই ‘ধ্রুবপদ’ বা ‘ধ্রুপদ’ বলতে এক প্রকার ধীর, স্থির, গম্ভীর ও বীরত্বব্যঞ্জক সঙ্গীতকে বোঝায়।

ভারতবর্ষে ধ্রুপদ গানের চর্চা কখন থেকে শুরু হয় তা সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। মহর্ষি ভরতের সময় ‘ধ্রুবা’ নামে এক প্রকার গানের প্রচলন ছিল, যার পরম্পরা চলছিল খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতক পর্যন্ত। তবে আধুনিক ধ্রুপদ গানের আবিষ্কারক হিসেবে গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমরকে ধরা হয়। কেউ কেউ বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ নায়ক গোপাল ও তাঁর সমসাময়িক নায়ক বৈজুকে ধ্রুপদ গানের প্রবর্তক বলে মনে করেন। তাঁদের মতে ধ্রুপদের আগে ‘প্রবন্ধ’ নামে এক প্রকার গানের প্রচলন ছিল। তার অনুকরণে ধ্রুপদ গানের সৃষ্টি হয়। কিন্তু অধিকাংশের মতে রাজা মানসিংহ তোমরই ধ্রুপদ গানের স্রষ্টা। তাঁর সহধর্মিণী মৃগনয়নীও ধ্রুপদ গানে বিশেষ পারদর্শিনী ছিলেন।

ধ্রুপদের বিষয় প্রধানত স্রষ্টার প্রশংসা বা ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা বীরদের প্রশস্তি। এতে জমজমা, মুর্কি বা গিটকিরি নিষিদ্ধ। অত্যন্ত সহজ কায়দায় বিলম্বিত লয়ে এ গান পরিবেশন করা হয়। ধ্রুপদ এক সময় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক বিশেষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু বিগত এক-দেড়শ বছরে  খেয়াল গান অধিক জনপ্রিয় হওয়ায় ধ্রুপদের চর্চা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে।

ধ্রুপদ গানের রচনায় কবিত্বের প্রকাশ থাকে। ভাবের মাধুর্য, ভাষার শুদ্ধতা, গীতরীতির গাম্ভীর্য, ছন্দোবৈচিত্র্য প্রভৃতি এ গানের বৈশিষ্ট্য। মোগল সম্রাট  আকবর ধ্রুপদ গানের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারের সব সঙ্গীতগুণীই ছিলেন ধ্রুপদী। মিঞা তানসেন ছিলেন সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদশিল্পী।

ধ্রুপদ গানে সাধারণত চারটি ‘তুক্’ বা ভাগ থাকে, যথা স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। তবে কেবল স্থায়ী ও অন্তরা এ দুই তুক্বিশিষ্ট ধ্রুপদ গানের প্রচলন আছে। এ গান প্রধানত হিন্দি, উর্দু বা ব্রজভাষায় রচিত এবং এতে শৃঙ্গার, শান্ত অথবা বীররসের প্রাধান্য থাকে। একাধিক তালে ধ্রুপদ গায়ন প্রচলিত, যথা চৌতাল, সুরফাঁক, ব্রহ্মতাল, তেওড়া, রুদ্রতাল, ঝাঁপতাল ইত্যাদি। এ সকল  তাল পাখোয়াজ অথবা মৃদঙ্গে বাজানো হয়।

ধ্রুপদ পরিবেশনায় দুটি প্রধান অংশ লক্ষ করা যায়। প্রথমটি আলাপ অংশ। এর মুখ্য উদ্দেশ্য রাগের ধ্যানরূপ ফুটিয়ে তোলা। শিল্পী এ অংশে কোনো তালবাদ্যযন্ত্রের সহযোগিতা ছাড়া এবং গানের কথার পরিবর্তে নোম্, তোম্ ইত্যাদি নিরর্থক শব্দযোগে সুরের সূক্ষ্মতম অনুভূতিপ্রবণ প্রসারণ দ্বারা রাগের একটি আমেজ সৃষ্টি করেন। এ ক্ষেত্রে শিল্পী কেবল তানপুরা ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় অংশে শিল্পী তালবদ্ধ বাণী অর্থাৎ বন্দিশ গেয়ে থাকেন। ধ্রুপদ শব্দপ্রধান গীতশৈলী এবং এর শব্দের প্রতিটি অক্ষর তালের মাত্রার সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে সুরে প্রলম্বিত করা হয়।

ধ্রুপদ গানে চার প্রকার বাণীর প্রচলন দেখা যায়, যথা শুদ্ধ বা গওহর বাণী, খান্ডার বাণী, ডাগুর বা ডাগর বাণী ও নওহার বাণী। আকবরের দরবারের চারজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞের বাসস্থানের নামানুসারে এ বাণীগুলির নামকরণ করা হয়েছে। তানসেনের বাসস্থান গোয়ালিয়রে, তাই তাঁর রচিত ধ্রুপদের বাণীকে বলা হয় ‘গওহর বাণী’। এ বাণীর বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি খুবই স্পষ্ট এবং সাধারণত ধীরগতিসম্পন্ন, গম্ভীর ও শান্তরসপ্রধান। তানসেনের জামাতা বীণকার মিশ্রী সিং বা সম্মুখন সিং (পরে নৌবাৎ খাঁ নামে পরিচিত)-এর বাসস্থান খান্ডারের নামানুসারে তাঁর রচিত বাণীর নাম হয় ‘খান্ডার বাণী’। এ বাণীর গানগুলি অতি বিলম্বিত লয়ে চলে এবং গওহর বাণীর চেয়ে অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ বাণীর গানে স্বরগুলি সরলভাবে না দেখিয়ে খন্ডখন্ডভাবে দেখানো হয়ে থাকে। সঙ্গীতসাধক বৃজচন্দের বাসস্থান ডাগুর গ্রামের নামানুসারে তাঁর রচিত ধ্রুপদ গানের নাম হয় ‘ডাগুর বা ডাগর বাণী’। এর বৈশিষ্ট্য হলো সহজ ও সরলতা। শ্রীচন্দের বাসস্থান নওহারের নামানুসারে তাঁর রচিত ধ্রুপদ গানের নাম হয়েছে ‘নওহার বাণী’। এক বা একাধিক স্বর অতিক্রম করে অপর স্বরে যাওয়া-আসা করা এ বাণীর বৈশিষ্ট্য। নওহার বাণীর ধ্রুপদ সাধারণত গতিবেগসম্পন্ন হয়ে থাকে। ধ্রুপদ গানের গায়ক ‘কলাবন্ত’ নামে পরিচিত।

বাংলায় প্রথম ধ্রুপদের চর্চা শুরু হয় আঠারো শতকের শেষ দিকে বিষ্ণুপুরে। এর আগে বাংলার অন্য কোথাও ধ্রুপদ চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাংলা সঙ্গীতের নবজাগৃতির প্রস্ত্ততিপর্বে বিষ্ণুপুরে ধ্রুপদের চর্চা শুরু হয়। এখানে ধ্রুপদের যে ধারা প্রবর্তিত হয়, তৎকালীন বাংলাদেশে তা একমাত্র ঘরানারূপে পরিচিত। বিষ্ণুপুর ঘরানা ধ্রুপদ সঙ্গীতে রামশঙ্কর ভট্টচার্যের অবদান অপরিসীম। তিনি ধ্রুপদের বন্দিশ রচনায় এবং শিষ্য পরম্পরায় ধ্রুপদ গান প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি হিন্দুস্তানী সঙ্গীতরীতিতে বাংলা ভাষায় অসংখ্য ধ্রুপদ রচনা করেন এবং নিজে গেয়ে বাংলা ভাষার মাধ্যমে ধ্রুপদের সঙ্গে বাঙালিদের পরিচিত করান। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে  ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, রামকেশব ভট্টাচার্য, কেশবলাল চক্রবর্তী, অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুভট্ট প্রমুখ বিষ্ণুপুর ঘরানার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার এ ধ্রুপদ ধারার সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত ছিল। রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ অঙ্গের গানগুলি বাংলা সঙ্গীতের অসাধারণ সৃষ্টি।

বিভাগপূর্ব বাংলাদেশে অনেক শিল্পীই রাজা ও নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধ্রুপদ চর্চা করতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যপরম্পরায় এ চর্চা হতো। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ওস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দীন, প্রমুখ এ দেশেরই সন্তান ছিলেন, যদিও তাঁদের চর্চার ক্ষেত্র ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল।

বাংলাদেশে ধ্রুপদ সঙ্গীতের ধারা আজ বিলুপ্তপ্রায়। দু’চারজন শিল্পী ছাড়া এ ধারার চর্চা এখন আর কেউ করেন না। [মোবারক হোসেন খান]