ধোপা

ধোপা  কাপড় ধোয়া ও ইস্ত্রি করার কাজে নিয়োজিত একটি পেশাজীবী সম্প্রদায়। রজক নামে অভিহিত হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্ন বর্ণজাত ধোপারা আগের দিনে সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণি ও জমিদারদের কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করত। কিন্তু কালের বিবর্তনে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে ধোপাদের কাজের পরিধি বেড়ে যায়। প্রাচীনকালে কলার খোল পুড়িয়ে পটাশ তৈরি করা হতো এবং তা কাপড় পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে এ কাজে তারা সোডা বা ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে।

ধোপা কর্মরত

সোডা বা ব্লিচিং পাউডারমিশ্র পানিতে প্রথমে কাপড় ভিজানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে কাপড় জড়ো করে সেগুলি চুলায় বসানো একটি বড় পাত্রে সিদ্ধ করা হয়। প্রয়োজনে সাবানও ব্যবহূত হয়। পরে একটি কাঠের বোর্ডে কাপড়কে প্রয়োজনমতো আছড়ানো হয়। সবশেষে তা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। কিছু কাপড়ের জন্য মাড় বা এরারুটের গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের লালচে বা হলুদাভা দূর করে তা নীলাভ বা সাদা করার জন্য নীল ব্যবহার করা হয়। পুরো কাজ সমাধা হয় কাপড় ইস্ত্রি করার মধ্য দিয়ে। পর্তুগিজরাই প্রথমে কাপড় ইস্ত্রি করার প্রথা চালু করে। বাংলার ‘ইস্ত্রি’ শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ ভাষা থেকে।

ধোপা শ্রেণি তাদের পূর্বসূরি হিসেবে দাবি করে নেতা মুনি বা নেতা ধোপানীকে। তাদের বিশ্বাসমতে, তিনি ব্রহ্মার কাপড় ধৌত করেছিলেন। ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুরা কাপড় ধোয়াকে সম্মানজনক মনে করত না, তাই প্রাচীন বাংলায় ধোপারা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিরাজমান ছিল এবং তারা খুব বেশি উপবর্ণে বিভক্ত ছিল। বাংলায় বিখ্যাত দুটি উপবর্ণের মধ্যে ছিল রামের ধোপা ও সীতার ধোপা। উভয়ে নিজেদের যথাক্রমে রামের ধোপা ও সীতার ধোপাকে তাদের পূর্বসূরি মনে করত। এ দুই উপবর্ণের সদস্যরা একসঙ্গে পানাহার করে কিন্তু তারা কখনও আন্তঃবিবাহ করে না।

অধিকাংশ নিম্নবর্ণের ন্যায় ধোপারা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তাদের মধ্যে গুটিকয়েক শাক্ত ধর্মের অনুসারী।

অতীতে কদাচ দুয়েকজন মুসলমানকে এ পেশায় দেখা যেত। বর্তমান বাংলাদেশে এ পেশায় হিন্দুরা একচেটিয়াভাবে নিয়োজিত নেই। ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাংলার এ অংশে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া এর কারণ। তাছাড়া কাপড় পরিষ্কারের প্রযুক্তিতে পরিবর্তন এবং মুনাফা লাভের সুযোগ, বেকারত্ব ও কাপড় পরিষ্কারের প্রতি সাধারণ মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন অনেক মুসলমানকে এ পেশায় আসতে সহায়তা করেছে। ড্রাই ক্লিনিং ও কাপড় পরিষ্কারের অটোমেটিক মেশিন আবিষ্কার সনাতনী ধোপাদের প্রতিস্থাপন করে চলছে। বর্তমানে শহরের অনেক বস্ত্র পরিষ্কারক প্রতিষ্ঠান অটোমেটিক ও সেমি অটোমেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সনাতনী ধোপারা উদীয়মান ব্যবসায়ী শ্রেণির সাবকন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করে থাকে। এতদ্সত্ত্বেও গ্রাম ও শহরতলিতে সনাতনী ধোপারা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে ধোয়া, পরিষ্কার ও ইস্ত্রি করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।  [গোফরান ফারুকী]