ধর্মপাল, অনাগরিক

ধর্মপাল, অনাগারিক (১৮৬৪-১৯৩৩)  বৌদ্ধপন্ডিত ও ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণের অগ্রদূত। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরে ধনাঢ্য হেওয়া বিতরণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাল্য নাম ছিল ডন ডেভিড হেওয়া বিতরণ। পিতা ডন কেরোলিস মুডালিয়ার হেওয়া বিতরণ ছিলেন কলম্বোর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী।

ধর্মপালের পিতামহ ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক এবং পাশ্চাত্য মনীষী কর্নেল হেনরি স্টিল অলকট প্রতিষ্ঠিত থিওসোফিক্যাল সোসাইটির কলম্বো শাখার প্রতিনিধি। ডন ডেভিড মাত্র ১৪ বছর বয়সে এই সংস্থার কর্মী হয়েছিলেন। এখান থেকেই বৌদ্ধধর্ম-দর্শন বিষয়ে তাঁর চর্চা শুরু হয়। তিনি সেন্ট টমাস নামে এক খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। অধ্যয়নকালে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি বরং সতীর্থদের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতেন। এ অপরাধে তাঁকে বহুবার স্কুল ত্যাগ করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহলের একটি স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানেই তাঁর বিদ্যার্জন সম্পন্ন হয়। ১৮৮৬ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি ধর্মের পালক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করে ‘ধর্মপাল’ নাম ধারণ করেন। তিনি একই সঙ্গে ধর্ম-আন্দোলন, ভারতীয় মেধার সমন্বয় সাধন, প্রচার-পর্যটন এবং সংঘজীবন যাপন করেন।

১৮৯১ সালে অনাগারিক একজন জাপানি ভিক্ষুকে সঙ্গে নিয়ে সারনাথের ইসিপতন ও বুদ্ধগয়াসহ ভারতের বৌদ্ধ তীর্থসমূহ ভ্রমণ করেন। বুদ্ধগয়ায় গিয়ে তিনি বৌদ্ধধর্মের হারানো গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থভূমি বুদ্ধগয়া উদ্ধারের সংকল্প করেন মহাবোধি সোসাইটি। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে শ্রীলঙ্কায় গঠন করেন । এই সোসাইটির আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি শ্রীলঙ্কায় সদ্ধর্মের সুরক্ষা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচার ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের উৎপীড়ন থেকে স্বজাতিকে রক্ষা করতে সমর্থ হন।

১৮৯২ সালে অনাগারিক কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন মহাবোধি সোসাইটি অব ইন্ডিয়া। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী এবং সাধারণ সম্পাদক তিনি নিজে। এতে চট্টগ্রামের প্রতিনিধি ছিলেন নাজির কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী। এই সোসাইটি এবং এর বিভিন্ন আঞ্চলিক শাখা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মপাল ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণের আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সারনাথে বুদ্ধের ধর্মচক্রপ্রবর্তন-স্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মহাবোধি সোসাইটি লাভ করে। তিনি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর সারনাথ মূলগন্ধকূটি বিহারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সারনাথে তিনি গড়ে তোলেন ধর্মশালা, ইন্টারন্যাশনাল বুদ্ধিস্ট ইনস্টিটিউট এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৯৭ সালে বাংলায় যখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন অনাগারিক বিশ্বের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিকট থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন।

ভারতীয় মেধার সমন্বয় সাধন অনাগারিকের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তিনি মহাবোধি সোসাইটির কেন্দ্রীয় ও শাখা কমিটিতে মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস রাধাকৃষ্ণান, রাজা গোপালাচারী প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এঁরা সোসাইটির বিভিন্ন কাজে জোর সমর্থন জানিয়েছেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বুদ্ধগয়ার অধিকার অর্জনের ঘটনায়।

১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে The World’s Parliament of Religions শীর্ষক যে মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, বিশ্ববৌদ্ধদের পক্ষ থেকে ধর্মপাল তাতে প্রতিনিধিত্ব করেন। এতে তিনি The world debt to Buddha শীর্ষক পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ব বিশ্বপরিমন্ডলে পরিচিতি পায়। আমেরিকা গমনের সময় স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী এবং শিকাগো অবস্থানকালে বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অনাগারিক ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। লন্ডনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি বৌদ্ধ মিশন আছে।

ধর্মপাল শুধু ধর্মচর্চাই করেন নি, তিনি দেশের মুক্তির কথাও চিন্তা করেছেন; কখনওবা মুক্তি আন্দোলনে শরিকও হয়েছেন। তাই প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক কলকাতায় পাঁচ বছর অন্তরীণ ছিলেন। একজন শ্রীলঙ্কান নাগরিক হয়েও অনাগারিক ভারতীয়দের নৈতিক, আধ্যাত্মিক, শৈক্ষিক, শৈল্পিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এসব কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য তিনি তাঁর প্রাপ্ত পৈতৃক সম্পত্তি দ্বারা ‘অনাগারিক ধর্মপাল ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্টফান্ডও প্রতিষ্ঠা করেন।

ধর্মপালের এক বিশেষ কৃতিত্ব মহাবোধি  জার্নাল (১৮৯২) প্রকাশ। সোসাইটির মুখপত্র হিসেবে বৌদ্ধ ভাবাদর্শ, ঐতিহ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ জার্নাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শতবর্ষ প্রাচীন এ জার্নালটি ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

জীবনসায়াহ্নে ১৯৩১ সালে ধর্মপাল পরমার্থ লাভের বাসনায় মহাভিক্ষুব্রত গ্রহণ করেন। তিনি একজন থেরোর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করে দেবমিত্র ধর্মপাল নামে পরিচিত হন। ১৯৩৩ সালের ২৯ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়।  [রেবতপ্রিয় বড়ুয়া]