দিনাজপুর জমিদারি

দিনাজপুর জমিদারি লোকশ্রুতি অনুযায়ী জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ নামের ব্যক্তি দিনাজপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর নামানুসারেই দিনাজপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। মুগল সম্রাট আকবরএর শাসনামলে ব্রহ্মচারী ও মোহন্ত হিসেবে পরিচিত কাশী ঠাকুর নামক একজন সন্ন্যাসী দিনাজপুর ও মালদা জেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকারী হন। কাশী ঠাকুর নিজেকে রাজা গণেশএর বংশোদ্ভূত বলে দাবি করতেন। জানা যায়, তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁরই প্রিয়ভাজন কায়স্থ শিষ্য শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরীকে উইল করে দিয়ে যান। পরবর্তীকালে এ সম্পত্তি শ্রীমন্তের দৌহিত্র সুখদেব উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। সুখদেব রংপুর, বগুড়া ও মালদা,  দিনাজপুর এবং বগুড়ায় প্রতিষ্ঠিত জমিদারির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তিনি এ জমিদারি দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও-এর অন্তর্ভুক্ত ঘোড়াঘাট, নবাবপুর, ক্ষেতলাল, শিবগঞ্জ, পাঁচবিবি, বদলগাছি ও আদমদীঘি থানায় সম্প্রসারণ করেন।

বিশাল এ জমিদারির বিবেচনায় সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূুষিত করেন। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রাণনাথ উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি। প্রাণনাথই ১৭২২ সালে পোড়ামাটির অলংকরণ সমৃদ্ধ অসাধারণ কান্তনগর মন্দিরটির (নব-রত্ন মন্দির) নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি। মন্দিরটি নির্মাণে প্রায় ত্রিশ বছর সময় লাগে এবং ১৭৫২ সালে তাঁরই মতো ক্ষমতাবান ও যোগ্য উত্তরসূরি তাঁর পালক পুত্র রামনাথ এটি সম্পন্ন করেন।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রশাসন যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে সে সময় দিনাজপুর জমিদারি ছিল বাংলার সবচেয়ে বড় জমিদারিগুলোর একটি। এ জমিদারির অনুমিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৪,৮৪,০০০ সিক্কা রুপি। দিনাজপুর জমিদারি ছিল সে সময়ের তৃতীয় বৃহত্তম জমিদারি। বর্ধমান ও রাজশাহীর জমিদারির পরেই ছিল এর অবস্থান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের দশ বছরের মধ্যে দিনাজপুর জমিদারিসহ বাংলার সব কয়টি বড় জমিদারির চূড়ান্ত পতন ঘটে। যথাসময়ে রাজস্ব জমা দিতে না পারায় যেদিন থেকে এ জমিদারির অন্তর্গত জমি বিক্রি শুরু হয়, তার পরের পনেরো মাসের মধ্যে প্রায় পুরো দিনাজপুর জমিদারি নিলামে ওঠে। যথাসময়ে রাজস্ব দিতে না পারার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল ১৭৯৮ সালের ভয়াবহ খরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ফকির-সন্যাসীদের বিদ্রোহ। কোম্পানির কালেক্টরেট কর্মকর্তাদের সঙ্গে জমিদারদের দ্বন্দ্বও এ জমিদারির পতনের অন্য একটি কারণ ছিল। রায়ত বা কৃষকরা খাজনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ফলে জমিদাররাও তাদের রাজস্ব সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি। এ রাজস্ব আদায়ে সরকার নিলামের মাধ্যমে জমিদারি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে। রাজা রাধানাথের জমিদারি আমলে দিনাজপুর জমিদারি নিলামে উঠেছিল।

১৮০০ সালের পর দিনাজপুর জমিদারি টিকে থাকলেও তা ছিল পূর্বতন আমলের দিনাজপুর জমিদারির ছায়ামাত্র। ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কান্তজী মন্দির ও জমিদারবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তীকালে মহারাজা গিরিজানাথ রায়বাহাদুরকে এর সংস্কার করতে হয়েছিল। তাঁর পালক পুত্র জগদীশনাথের আমলে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট, ১৯৫০ অনুসারে এ জমিদারি বিলুপ্ত হয়। ১৯৬২ সালে কলকাতায় জগদীশনাথ-এর মৃত্যু হয়।  [নাজিমউদ্দীন আহমেদ এবং সিরাজুল ইসলাম]

গ্রন্থপঞ্জি  KW Strong, EB District Gazetteer, Dinajpur, Allahabad, 1912; George Michell (ed), Brick Temples of Bengal, New Jersy, 1983; Nazimuddin Ahmed, Building of the British Raj in Bangladesh, Dhaka, 1986.