দত্ত, উমেশচন্দ্র

দত্ত, উমেশচন্দ্র (১৮৪০-১৯০৭) শিক্ষাবিদ, সংগঠক, সম্পাদক, লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম কায়স্থ পরিবারে, ১৮৪০ সালে ১৬ ডিসেম্বর, চবিবশ পরগণা জেলার মজিলপুর গ্রামে। পিতা হরমোহন দত্ত, মাতা সর্বমঙ্গলা দেবী। তিনি লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ইনিস্টিটিউশন থেকে ১৮৫৯ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। এ বছরই তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। শিক্ষকতা করেন বিজয়নগর বিদ্যালয় (১৮৬২), ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি (১৮৬৩), চবিবশ পরগণার দত্তপুকুর নিবধই মিডল ইংলিশ স্কুল (১৮৬৪), রাজপুর বিদ্যালয় (১৮৬৬), হরিনাভ হাইস্কুল (১৮৬৭-৬৯), কোণ্ণনগর হাইস্কুল (১৮৭০-৭৪), সিটি স্কুল (১৮৭৯) প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ইতোমধ্যে তিনি এফএ (১৮৬৬) ও বিএ (১৮৬৭) পাস করেন।

১৮৮১ সালে উমেশচন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। উমেশচন্দ্র দত্ত, ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার ফলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,  অক্ষয়কুমার দত্তরামতনু লাহিড়ীআনন্দমোহন বসুকেশবচন্দ্র সেন, প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসেন। অক্ষয়কুমার দত্তের রচনাবলী পড়ে তিনি সমাজসংস্কার কর্মে, বিশেষ করে নারীশিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এ লক্ষ্যে বামাবোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা (১৮৬৩-১৯০২) তাঁর এক প্রধান কৃতিত্ব। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে তাঁর এ পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পত্রিকাটি তিনি চল্লিশ বছর সম্পাদনা করেন। দেশে নারীশিক্ষা ও প্রগতির প্রসার করাই এ পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। বামাবোধিনী পত্রিকা ছাড়াও তিনি সাপ্তাহিক ধর্মসাধন (১৮৭২) ও সাপ্তাহিক ভারত-সংস্কারক (১২৮০) সম্পাদনা করেন।

উমেশচন্দ্র দত্ত সমাজসেবক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৯৩ সালে বহু চেষ্টায় তিনি ‘কলকাতা মূক-বধির বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিকলাঙ্গ শিশু ও বালক-বালিকাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ বিদ্যালয় বিশেষ অবদান রাখেন। প্রতিষ্ঠা থেকে জীবনের শেষ অবধি তিনি এ বিদ্যালয়ের সম্পাদক ছিলেন। নারীশিক্ষার উন্নতির জন্য  উমেশচন্দ্র দত্ত দুটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। প্রথমটি তাঁর নিজ গ্রাম মজিলপুরে, দ্বিতীয়টি কলকাতার বেনিয়াটোলায়। মদ্যপান নিবারণের উদ্দেশ্যে তিনি মেট্রোপলিটন টেম্পারেন্স এ্যান্ড সোসাইটি’ গঠন করেন। তিনি ছিলেন এর সহ-সভাপতি। উমেশচন্দ্র দত্তের চেষ্টায় ও উদ্যমে কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের সমাধিতে স্মৃতি-ফলক নির্মিত হয়।  ১৮৮৮ সালের ১ ডিসেম্বর এ স্মৃতি-ফলক উন্মোচন করেন মনোমোহন ঘোষ। তিনি কলকাতার বেথুন কলেজের কার্যনির্বাহী সমিতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য হিসেবে অবদান রাখেন।  তিনি ১৯০৩ সালে ২৪ ডিসেম্বর লুপ্তপ্রায় ‘মজিলপুর জয়নগর হিতৈষিণী সভা’র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

সহজ, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা ও মহৎ আদর্শের প্রতীক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত। উদার মনোভাবসম্পন্ন উমেশচন্দ্র দত্ত সারাজীবন নিজেকে সমাজ সেবায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে তিনি বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। এ শিক্ষায় নারীরা নিজেদের উন্নতি ও মুক্তির জন্য চেষ্টা করবে, এ ছিল তাঁর একান্ত কামনা। তিনি রোমের ইতিহাস (১৮৫৯) ছাড়াও নারী শিক্ষা (১৮৮৪) নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন।  মৃত্যু ১৯ জুন ১৯০৭। [মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম]